মনের অজান্তেই আমার মনে হয় বন্ধু মহলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে তারা একটু অন্যরকম সম্মান করছে আমাকে, ইংরেজিতে স্ট্যাটাস দিলে মনে হয় আমি হয়ত বেশ যোগ্যভাবে নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারছি। কথার মধ্যে দুই চার লাইন ইংরেজি বললেও সেটা মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দেয়।
এই অনুভূতিটা যদি শুধু আমারই হত তাহলে বুঝতাম এটা আমার ব্যক্তিগত সমস্যা। কিন্তু আমার আশে পাশে অনেকের সঙ্গেই এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি। তাদের অভিজ্ঞতা ও মতামত একেবারে আমার মতই। এরপর থেকে বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে, কেন এটা হয় আসলে?
আমার ক্ষুদ্র মাথা থেকে যেটা বের হলো, যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা আসলে বাংলা বলেন না। বাঙালি অনেক তারকাই আমাদের প্রিয়। তাদের আমরা অনুসরণ করি, পছন্দ করি। কিন্তু তারা যদি বাংলায় স্ট্যাটাস দিতে কার্পণ্য করেন, সেটা আমাদের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়।
এরপর যে বিষয়টি আসে, রাজধানী ঢাকায় যারা পড়াশোনা করে তারা বেশ আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে। গ্রাম বা মফস্বলের একটা শিক্ষার্থীর তুলনায় এগিয়ে থাকে তারা। সুতরাং তাদের জীবনযাপনকে আমরা অনুসরণীয় মনে করি। তাদের ইংরেজি পারদর্শীতা, বাংলিশ কথা বলা বা সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়াকে আমরা যোগ্যতার মানদণ্ড মনে করে থাকি। মনের অজান্তেই এটা আমাকে বুঝিয়ে দেয় যে, কথা বলার এই পদ্ধতিটিই হয়ত আধুনিক ও যোগ্য হিসেবে আমাকে ফুটিয়ে তোলে।
আরও একটি বিষয় আমি খেয়াল করেছি, অত্যাধুনিক রেঁস্তোরা, পাঁচ তারকা হোটেল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যারা নিজেদের বেশভূষা ও কাজের মাধ্যমে আসলেই বেশ এগিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যারা চলছে তারা বাংলাটাকে অবজ্ঞা করে বলেই মনে করি আমি। যারা এগিয়ে গেছে তাদের আমরা অনুসরণ করি, তাদের মত হতে চাই আমরা। তারপর মনের অজান্তেই নিজের ভাষা বা সংস্কৃতিকে অপমান করে ফেলি।
আমরাই প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দেওয়ার ভাষা আমরা মেনে নেইনি। আমাদের ইতিহাসটা গৌরবান্বিত। আমাদের এই ইতিহাস আজ পৃথিবীজুড়ে পালিত হয়। এটা শুধু বাংলার ইতিহাস না, পুরো বিশ্ব একুশে ফেব্রুয়ারিতে মায়ের ভাষাকে সম্মান জানায়। আমরা এমন একটি ইতিহাস তৈরি করেছি।
আমরা স্বর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চালু করতে পারিনি। তবে কিছু কিছু পরিবর্তন মনে আশা জাগায়। এখন মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো তাদের ক্ষুদে বার্তাগুলো বাংলায় পাঠায়, সরকারি বার্তাগুলো বাংলায় আসে। শুধু তাই নয়, নামি-দামি দোকান, রেঁস্তোরা, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন দপ্তর তাদের নামফলক এখন ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও লিখছে।
তবে ব্রিটিশ শ্বাসনের প্রভাব থেকে মনে হয় এখনো আমরা পুরোপুরি বের হতে পারিনি। যেমন এখনো আমাদের উচ্চ আদালত রায় দেয় ইংরেজিতে, অনেক সরকারি দপ্তরেও রয়েছে ইংরেজির ব্যবহার। যেমন বাংলাদেশের দমকল বাহিনীর দাপ্তরিক নাম, 'বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স'।
আমি মনে করি সরকার ও গণমাধ্যম চাইলে সব পারে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে ভাবায়, পথ দেখায়। অনেক বেতার ও টেলিভিশন উপস্থাপকরা বাংলিশ কথা বলেন। তবে সংবাদপত্র এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়। তারা চাইলে আরও পরিবর্তন আনতে পারে আমাদের মধ্যে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও কম না। আমি টাঙ্গাইলে ভারতেশ্বরী হোমসে পড়াশোনা করেছি। এই প্রতিষ্ঠান আমার চিন্তা চেতনা ও ভাবনায় পরিবর্তন আনতে প্রথম সহায়ক। নিজ সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাক, অসাম্প্রদায়িকতা সবকিছুর শিক্ষা দেয় এই প্রতিষ্ঠান। বাংলা পার্বণগুলো বেশ ঘটা করে উদযাপন করে।
সবশেষে এটা পরিষ্কার করতে চাই, আমি বলছি না ইংরেজি জানাটা খারাপ। অবশ্যই একটি ভাষা শেখা আমাকে আরেকটু যোগ্য করে তোলে। আমি যদি মাতৃভাষা বাদে আরও দুইটা ভাষা শিখতে পারি সেটা আমার যোগ্যতা নিঃসন্দেহে আরেকটু বাড়িয়ে দিবে। ইংরেজি যেহেতু আন্তর্জাতিক ভাষা, সেহেতু এটা আমাদের শেখা উচিত। নিজেকে, নিজের দেশকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতেও তো আমাদের এই ভাষাটি জানতে হবে। কিন্তু সেই যোগ্যতা অর্জনের সাথে নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করার যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই না। আমি চাই সবাই আত্মবিশ্বাসের সাথে বাংলাটা বলতে শিখুক। হীনমন্যতা বা দ্বিধা বোধ না করুক।