"তোমার দাদু ঘি অনেক পছন্দ করতেন। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে সব সময় জোটাতে পারতেন না,-" বাবার মুখের এ কথাটি আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। অথচ তিনি ছিলেন একজন উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তার সন্তান। আমার দাদুর বাবার নাম সৈয়দ ওয়াজিহ। তিনি বৃটিশ-ভারত সরকারের একজন বন কর্মকর্তা ছিলেন। লোকে তাকে ওয়াজিহ ফরেস্টার বলে ডাকতেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলে। তিনি মেঘালয়ের কোনো এক বনে কর্মরত ছিলেন। সেখানেই বাড়ি করে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে গেলে সবকিছু ফেলে চার সন্তান নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন৷ কিন্তু কোনো এক কারণে তিনি তার পৈতৃক ভিটায় ফেরেননি। ভারতে তার বাড়ির সীমানা ঘেঁষা অঞ্চলে বসত গড়ে তোলেন। জায়গাটি এখনকার জামালপুর জেলার কামালপুরে। সেই সময়েই পরিবারটিতে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়।
এরপর সন্তানরা বড় হন। চার সন্তানের দুইজন ছেলে, দুইজন মেয়ে। মেয়ে দুইজনের একজনের নাম সৈয়দা পার্সিনা, আরেকজনের নাম সৈয়দা মোনাক্কা। বড় ছেলে আব্দুস সালাম লেখাপড়া করে সরকারি চাকরি পান।
আর আমার দাদু ছিলেন বিপ্লোবী। সমস্ত আন্দোলন, মিছিল, মিটিং এ তিনিই সবার আগে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমার দাদু সৈয়দ বদরুজ্জামান যুদ্ধে যোগদান করেন। তখন আমার বড় দাদুকে মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি বিলি করার অভিযোগে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। এদিকে আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের পরিবারকে আবার ভারতে আশ্রয় নিতে হয়।
দাদু জীবন বাজি রেখে যখন যুদ্ধ করছেন, অন্যদিকে বড় দাদু মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন। ভালো ইংরেজি জানা এবং সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার বদৌলতে তাকে এক পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার দাদু এবং পুরো পরিবারকে এক অসহ্য দুঃখ কষ্টে দিন কাটাতে হয়। স্বাধীনতার পর তিনি ২৮ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৯৯৯ সালের পহেলা নভেম্বর তার জীবনাবসান ঘটে।
যদিও ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সকল মুক্তিযোদ্ধার আত্মিক মৃত্যু ঘটেছিল। দাদুও ব্যতিক্রম ছিলেন না। ১৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়টাতে নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না কোনো সম্মান। তাদের মধ্যে সবসময় ভয় কাজ করত। তাদেরকে দেশের শত্রু মনে করা হতো।
চারদিকের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের এই বোধ জাগিয়ে তুলেছিল। তখন দাদু হয়ত দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন আর ভাবতেন, সত্যি কি দেশটাকে স্বাধীন করে অপরাধ করেছি?
না তুমি কোনো অপরাধ কর নাই দাদু। তুমি তো দিয়েছ আমাদের স্বাধীনতা। তোমার মৃত্যুর প্রায় দুই যুগ পরেও তোমার নাতি তোমায় স্মরণ করছে, স্মরণ করছে কোটি বাংলাদেশি, বাঙালি!