‘বাবা এখন শুধু স্মৃতিতে, ডায়েরিতে’

‘বাবা এখন শুধু স্মৃতিতে, ডায়েরিতে’

হুমায়ুন আহমেদের লেখায় পড়েছি হিমুকে তার বাবা মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তাই তাকে মহাপুরুষ বানানোর জন্য উপদেশ, প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। হিমু মাঝে মাঝে বাবার দেয়া উপদেশ মনে করে মহাপুরুষ হতে চায়। 

কিন্তু তার বাবার মতো আমার বাবার এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে মহাপুরুষ নয়, সৎ সাহসী আর সহজ বানাতে চেয়েছেন।

বাবা শিক্ষক ছিলেন, উপদেশ দিতেন সব সময়। অংক করার মাঝে যখন মুনাফা-অর্থের অংক চলে আসত তখনও উপদেশ দিতেন, “সৎ ভাবে উপার্জন করবে সবসময়।” বাবার দেওয়া উপদেশগুলো আমি ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। 

দিনে বাবা কী কী বলতেন সেটাও লেখা হয়ে যেত। পরীক্ষার ফল দেখে বাবা খুশি হতেন কিন্তু প্রকাশ করতেন না সরাসরি। জীবনে যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে বাবার চাওয়াগুলো পূরণ করতে চেষ্টা করেছি।

প্রতিবেশিদের কাছে ছেলের কথা গর্ব করেই বলতেন, গল্প করতেন। গত বছর প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় বিজ্ঞানে একটু খারাপ করলাম, প্রথম হতে পারলাম না। হয়ে গেলাম দ্বিতীয়। আমার কান্না দেখে কে! অবাক ব্যাপার বাবা খুশি আমার কান্না দেখে। তিনি হাসলেন!

রাতে কেঁদেকেটে ঘুমিয়ে পড়েছি, বাবা এসে ডেকে তুললেন। হাসতে হাসতে বললেন, "কী ব্যাপার এত মন খারাপ কেন? ওয়ার্ম আপ ম্যাচে হেরেছ বলে মন খারাপ করেছ?"

বললেন, এই পরীক্ষায় একটু খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে? সামনে জেএসসি লতে নিশ্চয়ই এই ভুল হবে না।

তখন বুঝতে পারলাম বাবার কথা। আসলেই তো এই পরীক্ষা তো কিছুই না, সামনে আরো কত পরীক্ষা আছে!

এখানে যা ভুল হয়েছে তা শুধরে নিয়ে সামনের পরীক্ষায় কাজে লাগাব। সাহস পেয়ে গেলাম। যতবার কোনো ঘটনায় কষ্ট পেয়েছি, ততবার আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আমার বাবা। তার অমূল্য-অমৃতসম কথার ধারে আমি হেরে গেছি।

বাবা বলতেন, "হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে যদি শুয়ে থাক তবে সেটা তোমার ব্যর্থতা। অসাবধানতাবশত হোঁচট খাবেই। তবে খেয়াল রাখবে জীবনে অসাবধানতাবশত যেন হোঁচটও না খাও।" তার কথাগুলোই আমার শক্তি।

বাবার কথাগুলো শুনলে যতই মন খারাপ থাকুক ভালো হয়ে যেত। প্রিয় বন্ধুর সাথে ঝগড়া হয়েছে, বাবা বলতেন, "বন্ধুত্ব হলো কাঁচের গ্লাসের মতো। যদি ভেঙে যায় আর জোড়া লাগানো যায় না। তাই সব সময় বন্ধুত্বকে সম্মান করবে, ভেঙে যেতে দেবে না।"

একবার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ফাইনাল রাউন্ড পর্যন্ত গেলাম একদম সুন্দরভাবে। ফাইনালে গিয়ে গলা ভেঙে গেল, জেতা বিতর্ক হেরে গেলাম। স্বাভাবিক ভাবেই মন খারাপ। বাবা আবার সাহস দিলেন।

শুনেছি এখন সবাই নাকি জিপিএ-পাঁচের পেছনে ছোটে। আমিও ছুটতে চেয়েছিলাম। বাবা ঘাড় ধরে টেনে এনেছেন। বলেছেন, "জিপিএ দিয়ে মেধা বিচার করবে না। পৃথিবীর মহান ব্যাক্তিত্বদের দিকে তাকিয়ে দেখবে, তাদের নামের পরে লেখা নেই জিপিএ-পাঁচ আছে কি না।  এভাবে ছুটে চললে তোমার জীবন ওই পাঁচ সংখ্যাতেই আটকে থাকবে আর বড় হবে না।"

বাবা বলতেন,’ ক্ষমাশীল হও, সহনশীল হও। অন্যায় দেখলে মাথা উঁচু করবে রুখে দেয়ার জন্য, কিন্তু ন্যায়ের সাথে নত থাকবে সব সময়। মনে রাখবে, যে যত নত সে তত উন্নত।"

এ যুগে এমন অভিভাবক খুব কমই আছেন, যিনি সন্তানকে জিপিএর পেছনে ছুটতে বারণ করেছেন। শুধু বারণ নয়, একদম কড়া করে নিষেধ করে দিয়েছিলেন বাবা আমাকে।

বাবার এ কথাগুলো সাজিয়ে রেখেছি আমার ডায়রিতে। কেন রেখেছি জানি না। হয়ত মন বুঝেছিল মানুষটি অকালেই চলে যাবে! গেল বছরের ২২ জুলাই, আমার জীবনের মহান এই শিক্ষক চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন।

তাতে কী? আমি যে সব টুকে রেখেছি। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক আমার বাবা। শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের ছাত্র আমি।

Related Stories

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com