প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমবেশি সারাদেশেই হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে উপকূলের মানুষ । ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ এর আইলা আজও উপকূলবাসীকে কাঁদায়। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে এই ঝড়গুলোর কাছে।
খবরে শুনেছিলাম সাগরে একটি নিম্নচাপ বিরাজ করছে এটি ঘূর্ণিঝড়ের রুপও নিতে পারে। যদি রুপ নেয়, তবে নাম হবে বুলবুল। আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কাই সঠিক হয়। বুলবুল আঘাত হানে।
এর প্রভাবে শুক্রবার সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। আবহাওয়া দপ্তর তিন নম্বর সংকেত জারি করলো। সকালেই এক সভার আয়োজন করল রেডক্রিসেন্ট, আমিও গিয়ে যোগ দিলাম সেখানে। বিভিন্ন দিকনির্দেশনা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো সভায়।
এরপর রেড ক্রিসেন্ট ভবনের সামনে টানানো হয় একটি লাল পতাকা। এদিকে আবহাওয়া বার্তায় জানানো হচ্ছিল, ঘূর্ণিঝড়টি প্রবল হতে চলেছে, যে কোনো মুহুর্তে সংকেত বাড়ানো হতে পারে। মোংলা, রামপাল, শরণখোলাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়। রেডক্রিসেন্ট সদস্যরা কীভাবে কাজ করবে, কী কী করবে ততক্ষণে ঠিক করা হয়ে গেছে।
শনিবার সকালে জানতে পারি ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া দপ্তর। এর অর্থ প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বন্দরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকবে এবং ঘূর্ণিঝড়টি বন্দরের খুব কাছ দিয়ে, অথবা ওপর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এই মহাবিপদ সংকেত বোঝাতে তিনটি লাল পতাকা ওড়ানো হয়।
রেডক্রিসেন্ট থেকে জরুরী সভা ডাকা হলো। খোলা হলো নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। একটি পতাকার সঙ্গে আরও দুটি লাল পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হলো। বিপদের নিশানগুলো বাতাসে উড়ছিল। মনে মনে কাজ করছিল অজানা ভয়। এ সময় ছয় হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার প্রস্তুত করলো রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা। মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসার জন্য দলে দলে ভাগ করে সদস্যদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো বিভিন্ন এলাকায়।
তখন রেডক্রিসেন্ট সদস্যরা মাঠে কাজ করে যাচ্ছে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে ব্যস্ত, কেউ মানুষকে বোঝাতে ব্যস্ত, কেউ বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধী, নারীদের জন্য বিশেষভাবে কাজ করছে। মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চায় না। বাড়ি-ঘরে লুটপাটের ভয় থাকে, গবাদি পশু নিয়ে আশঙ্কা থাকে। এছাড়া নানা কারণে মানুষ বাড়িঘর ছাড়তে চান না। আবার অনেকে বলে বাতাস ছুটলে আশ্রয় কেন্দ্রে যাবেন।
এর আগেই স্কুল-কলেজে ছুটি দিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।
রাত তখন আনুমানিক নয়টা। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। আমি আর আমার বন্ধু রাতুলের নজরে আসে রাস্তায় বড় এক গর্ত হয়ে আছে। গর্তটা এমন জায়গায় যে, অন্ধকারে মানুষ বুঝতেই পারবে না। ঝড় আঘাত হানার পর মানুষ ছোটাছুটি করলে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। বাঁশ জোগাড় করে সেখানে পুঁতে দেই আমরা। লাল কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই সঙ্গে বেঁধে দেই একটা শপিং ব্যাগ।
এরপর বাড়ি ফিরে বারবার খবরে নজর রাখছিলাম কোথায় কী হচ্ছে জানার জন্য। বিদ্যুৎ চলে গেছে। কিন্তু ইন্টারনেটের কল্যাণে সব খবরই জানতে পারছিলাম। শেষ অবধি দুর্বল হয়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। সুন্দরবনের অজস্র গাছপালার জন্য বাতাসের গতিবেগ প্রায় ২০ কিলোমিটার কমে যায়।
অনেক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বেঁচে যায় বাংলাদেশ। আমার বাড়ি থেকে সুন্দরবন মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বের। এরজন্য অন্য রকমের একটি মায়া আমার কাজ করে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভয় পাচ্ছিলাম। মানুষদের নিয়ে যেমন ভাবছিলাম, তেমনি সুন্দরবনের প্রাণিদের নিয়েও ভাবছিলাম। তারা না জানি কী করছে। গাছ-পালার চাপায় হয় আহত হয়েছে অনেক প্রাণি।
আমরা মোকাবেলা করতে পেরেছি, সুস্থ আছি তাতেই খুশি। বেশি বেশি গাছপালা রোপণ করলে ভবিষ্যতেও হয়ত প্রকৃতি আমাদের পক্ষেই থাকবে।