হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে

তানভীর, সূচনা, দৃষ্টি, মিশরি, অর্ণব, আতিক, অনি, রিয়াসহ আরো কয়েকটি নামের সঙ্গে জীবনের এক ক্ষুদ্র অংশ এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে কোনো দিন হয়তো সেগুলো ভোলা সম্ভব না। এই মানুষগুলোর সাথে পরিচয় দ্বিতীয় শ্রেণি থেকেই।
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে

গ্রাম থেকে শহরে এসে যখন স্কুলে ভর্তি হলাম তখন ক্লাসে মাঝের দিকে কোনো বেঞ্চের কোণায় গিয়ে বসে থাকতাম। ম্যাডাম আসতেন, পড়াতেন, চলে যেতেন আমি আমার মতো চুপচাপ বসে থাকতাম। এই অবস্থার পরিবর্তন হলো প্রথম সাময়িক পরিক্ষায় প্রথম হওয়ার পর। এরপর কয়েকটা বন্ধু হলো। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এদের সাথেই ছিল গভীর সখ্যতা; অকারণ খুনসুটি মেতে থাকতাম সারাক্ষণ।

পঞ্চম শ্রেণিতে সরকারি স্কুলে চান্স পাওয়ায় চলে যেতে হলো, তখন থেকেই বলা যায় ওদের সাথে সম্পর্কে টান পড়লো। আর বলতে গেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সে রকম কারো সাথেই দেখা হয়নি পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে। দু একজনের সঙ্গে এখন মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হয়, চিনতে পারে না। আমিই এগিয়ে গিয়ে কথা বলি। আবার কখনও আমার মনে হয় কথা বলব? চিনবে না হয়তো।

ওদের সাথে কাটানো বেশ কিছু মজার ঘটনা যত্ন করে তুলে রেখেছি মনের কোণে ছোট্ট একটা স্মৃতির বাক্সে। বাক্সে মরিচা ধরলেও ভেতরের স্মৃতি অম্লান।

লেখাটা লিখতে বসেই মনে পড়ল একদিনের ঘটনা। একদিন ওয়াসরুমে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ফেলেছিলাম, রক্ত বের হচ্ছিল খুব। বাসায় বলতে ভয় হচ্ছিল দেখে চলে গেলাম স্কুলে। বাসার পাশে স্কুল হওয়ায় হাত চাপ দিয়ে ধরে এক দৌড়ে স্কুলে গেলাম। তখন তানভীরসহ আরো কয়েকজন রক্ত দেখে ঔষধের দোকান থেকে স্যাভলন আর ব্যান্ডেজ নিয়ে আসল, বেঁধে দিল ওরাই।

এরকম আরো কত কাহিনী ঘটেছে তা গুণে শেষ হবে না। আরেকটা মজার ঘটনা আছে। স্কুলে টিফিনের পর বিজ্ঞান ম্যাডাম এসে কোনো পড়া লিখতে দিয়ে নিশ্চিন্তে এক পিরিয়ড ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতেন। ঘুমানোর আগে যা লিখতে দিতেন তা দেখার দায়িত্ব ছিল আমাদেরই উপর। একজনের খাতা আরেকজন দেখতাম। যেদিন দৃষ্টির সাথে বেশি ঝগড়া হতো ওইদিন মারামারি করে হলেও আমার খাতা নিত। আর তারপরে প্রত্যেকটা লাইনে প্রত্যেকটা শব্দে ভুল ধরে লাল কালি দিয়ে গোল মার্ক করে দিত। একদম একটা শব্দের সামান্য মাত্রাও ভুল হলে সেটি ভুলের মধ্যে তালিকাভুক্ত হতো। শেষে দেখা যেত লেখার মধ্যে শুধুই লাল লাল বৃত্ত। আমিও মারামারি করে ওর খাতা নিয়ে এভাবেই খাতা দেখতাম আর ম্যাডাম আমাদের চিল্লাচিল্লিতে ঘুম থেকে উঠে খাতা দেখে বোকা দিত দুইজনকেই।

আমাদের প্রতিদিন বাংলা খাতার এক পৃষ্ঠা করে বাড়ি থেকে যেকোনো লেখা লিখে নিয়ে যেতে হতো। মাঝে মাঝে দৃষ্টি, মিশরি, অর্ণব, সূচনা চালাকি করে একবারেই বেশি করে লিখত কয়েকদিনের লেখা। আমি বোঝার সাথে সাথেই সবগুলো অতিরিক্ত লেখা ম্যাডামকে দেখিয়ে দিতাম। ম্যাডাম সাইন করে দিত আর ওদের চালাকিতে এভাবেই পানি ঢেলে দিতাম। এখানে আমার নিজের কথা না বললেই হবে না। আমিও যেদিন এই কাজ করতাম সেদিন ওরাও একই কাজ করে সব চালাকিতে পানি ঢেলে দিত।

কোনো একদিন ওদের কেউ স্কুলে না আসলে খুব মন খারাপ হতো। খুব মিস করতাম ওদের। এভাবেই চতুর্থ শ্রেণির শেষ দিন পর্যন্ত সখ্যতা, ঝগড়া আর খুনসুটিতে মেতে থাকতাম। পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই ওদের সাথে দেখা হওয়া কমে গেল। আর আরো বড় হতে হতে এক সময় আমরা হারিয়ে গেলাম। ওদের কেউ সিরাজগঞ্জ থেকে অনেক দূরের জেলায়, কেউ সপরিবারে ভারতে আর তাদের একজন বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়গুলো খুব গভীরভাবে মনে গেঁথে আছে শুধু সেই বন্ধুরাই নেই।  বন্ধু দিবসটা মাথায় আসতেই কেন যেন ওদের কথাই মনে হচ্ছে বারবার। যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস তোরা।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com