তখন সন্ধ্যা ৭ টার মতো বাজে। দেখলাম এক জায়গায় এক লোক ভ্যানে করে আনারস, পেয়ারা মাখা বিক্রি করছে। এগিয়ে সেদিকে গেলাম। কিন্তু সামনে যাওয়ার পর দেখি উনি লোক নন, আমার বয়সী এক কিশোর।
চুলগুলো উসকো খুশকো। পরনে একটা মলিন জামা। সেটা আবার ঘেমে লেপ্টে আছে গায়ের সঙ্গে।
অনেকেই ছেলেটার কাছ থেকে আনারস, পেয়ারা কিনছে। গিয়ে বললাম ১০ টাকার আনারস দাও। ছেলেটার কাজ খুব ধীর।
অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু ছেলেটা তখনও কাজ শেষ করতে পারেনি। এর মাঝে আমার বন্ধু ছেলেটাকে প্রশ্ন করল, পড়ালেখা কর না? ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বোঝালো পড়ে না। অবশ্য শুনে অবাক হইনি কারণ ছেলেটা পেটের দায়ে এ কাজ করছে। এর মাঝে লেখাপড়ার সুযোগ নেই। এরপর আমরাটাকা দিয়ে আনারস নিয়ে চলে আসলাম। আর কোনো কথা হলো না।
একটা কথা বলি, ছেলেটার কাজের মাঝে সততা দেখতে পেয়েছি। আনারস মশলা দিয়ে মাখানোর সময় একটা মশলা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে আমাদের সেটা না বললেও পারতো। কিন্তু ইচ্ছে করেই আমাদের বলল, ভাইয়া মশলা শেষ। ঈদের দিন বলে অনেক ভিড় ছিল, চাইলে মশলা ছাড়াই সে সব আনারস বিক্রি করতে পারত।
চলে আশার পর খাচ্ছি আর ভাবছি, আমাদের সাথে ছেলেটার জীবনের কতটা পার্থক্য। আমাদের চেয়ে ছেলেটার জীবন হাজার গুণ কষ্টের। নিজের জন্য পরিবারের জন্য ছেলেটার সারাদিন কত কষ্ট করতে হয়। নিজের পেট নিজে চালায়।
আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হই। হয়ত ছেলেটা নিজের ভ্যানটা পরিষ্কার করে, সব কিছু গুছিয়ে নেয়। আমাদের কাঁধে থাকে বই, খাতা ভর্তি ব্যাগ কিন্তু ছেলেটা ঠেলে নিয়ে যায় আনারস ভর্তি ভ্যান। আমরা গিয়ে ক্লাসে বসি। প্রতিদিনের মতোই সে ক্লাস, সে একই সহপাঠী, একই শিক্ষক। কিন্তু ছেলেটার দেখা হয় হাজারো রকমের মানুষের সাথে। একেকদিন একেক রকম মানুষ। কতো বিচিত্র জীবন।
দুপুরে আমরা টিফিন খাই। আচ্ছা ছেলেটা কি খায়? নাকি না খেয়ে টাকা বাঁচায়? নাকি খেলেও নামমাত্র কিছু?
বিকেলে আমরা খেলি, আড্ডা দেই আরো কতো কিছুই না করি কিন্তু ছেলেটার কাজ করেই বিকেল কাটে। রাতে আমরা পড়তে বসি। ছেলেটা ক্লান্ত শরীরে বাসায় এসে হয়ত রাতের খাবার খায়। খেয়ে হয়ত দেখে আজ কত টাকা লাভ হয়েছে। টাকার পরিমাণ দেখে হয়ত ছেলেটার মাথায় চিন্তা চলে আসে। হয়ত সে চিন্তা মায়ের ওষুধের জন্য, হয়ত ছোট ভাইবোনদের খরচের জন্য, হয়ত বাসার বাজার শেষ বাজারের খরচের জন্য।
ছেলেটার হয়ত প্রতিটা ঈদ চলে যায় সেই পুরনো শার্ট দিয়ে। আর আমরা অনেকে ঈদে দুই থেকে তিনটা জামা কিনি।
আচ্ছা এই পার্থক্য কি শেষ হবে না? হবে শেষ হবে যদি আমরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি। সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব এসব শিশুদের পাশে দাঁড়াই।