‘মিস ইউ, ক্লাস নাইন’

স্কুল নিয়ে আমার খুব বেশি অভিযোগ বা আফসোস কোনোটাই নেই। তবে আমার জীবনের সবচেয়ে পছন্দের ক্লাস হল 'ক্লাস নাইন'। আবার অপছন্দের ক্লাসগুলোর তালিকাতেও 'ক্লাস নাইন'কে সামনের সারিতেই ফেলতাম আমি।
‘মিস ইউ, ক্লাস নাইন’

খুব রহস্যময় এই ক্লাসটা আসলে আমাদের চারপাশের জগৎটাকে নতুন করে চিনতে শেখায়। আমি যখন নবম শ্রেণিতে উঠলাম, তখন মনের মধ্যে একই সাথে নতুন ক্লাসে ওঠার আনন্দ; আবার তার পাশাপাশি 'এত বড় বড় বইগুলো কী সত্যিই আমাকে পড়তে হবে?' এই দুশ্চিন্তায় খাওয়া-ঘুম বন্ধ হওয়ার যোগাড়।

যারা নবম শ্রেণিতে নতুন উঠেই নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়ে যায়। অনেকের মনে হতে পারে ক্লাস নাইন হয়ত আর পাঁচটা ক্লাসের মতোই। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার মতে ক্লাস নাইনের গুরুত্ব অন্য যেকোনো ক্লাসের থেকে একটু হলেও বেশি।

ক্লাস নাইনে প্রথমেই তো আমাদের একটা ছোটখাট যুদ্ধের মুখে পড়তে হয়! 'বিজ্ঞান, মানবিক না বাণিজ্য? কোনটা নেব?' নিজের কিংবা পরিবারের ইচ্ছানুসারে সবাইকেই শেষমেশ এরমধ্যে কোনো একটা বিষয় বেছে নিতে হয়। যাই হোক, ক্লাস নাইনে আমরা যে বিষয়টাই বেছে নেই না কেন সেটি নেয়ার ব্যাপারে শুধু বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজনের কথা না শুনে নিজেকেও একটু দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে হয়। ক্লাস নাইনের প্রথম দিন বইগুলোর সাইজ দেখেই পড়াশোনার উপর সেই 'ফোবিয়া' যেন আবার জেগে উঠেছিল আমার।

প্রথম প্রথম ফিজিক্স কিংবা কেমিস্ট্রির টার্মগুলোকে নিতান্তই আজগুবি মনে হতো। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি যে, পানির অপর নাম জীবন। সেই পানি নাকি আবার একটা পোলার যৌগ কিংবা লবণের একটা ছোট্ট দানার মধ্যেও নাকি অনেকগুলো অণু-পরমাণু থাকে। এসব কথা আবার সহজে বিশ্বাস হতে চায় নাকি? যাই হোক ক্লাস নাইনের প্রথমদিকের দিনগুলো মোটামুটি দুঃস্বপ্নের মতোই কেটেছিল আমার। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্টও ছিল ভুলে যাবার মতো একটা ঘটনা। বারবার মনে হতো পড়াশোনা-টোনা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। কিন্তু 'বাস্তবতা' নামক এক বিশেষ  বেড়াজালে বাঁধা বলেই ওই ধরনের চিন্তাকে সত্যি করার সাহস করে উঠতে পারিনি। তবে সেই চিন্তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

এর কৃতিত্ব খুব সম্ভবত হূমায়ুন আহমেদের। তার আত্মজীবনীমূলক একটা বই পড়ে জানলাম যে, তিনি যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পরীক্ষাটা দিয়েছিলেন তখন পুরো ক্লাসে সবচেয়ে কম মার্ক পেয়েছিলেন তিনি। আর পরে তিনিই সেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ১০০ তে ১০০ পেয়ে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। এটা পড়ে নিজেকে একটু একটু করে ভরসা করতে শুরু করলাম। ফলও হাতেনাতে পেলাম। ১০০ তে ১০০ না পেলেও কঠিন কঠিন বইগুলোকে আর আগের মতো কঠিন লাগত না। একটু একটু করে বুঝতে শিখলাম যে মানুষের জ্ঞানের পরিধি কতটা সমৃদ্ধ। আর একবার যখন ভীতিগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি তখন ক্লাস নাইনের বইগুলোই সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠল।

আমি আমার জীবনে অনেক বড় মানুষকে বলতে শুনেছি যে তারা নাকি আবার ক্লাস নাইন কিংবা টেনের জীবনে ফিরে যেতে চান। প্রথমে তো মনে হত তারা বোধহয় পাগল, নাহলে আমি ক্লাস নাইন পার করতে পারলে বাঁচি আর তার নাকি আবার এই নাইন পড়তে চান। কিন্তু এখন ধারণা একদম বদলে গেছে। এখন বুঝতে পারি যে ক্লাস নাইন আমাদের উপর শুধু কতগুলো বইয়ের বোঝাই চাপিয়ে দেয় না বরং দুনিয়াটাকে চিনতে শেখায়। প্রথম ৫/৬ মাসের অভিজ্ঞতাকে বাদ দিলে, আমার কাছে ক্লাস নাইন মানে শুধু একটা ক্লাসই না বরং ক্লাস নাইন মানে যেন নতুন একটা জগতে পা রাখা। আমাদের চরপাশের জগতে যে কত রহস্য লুকানো সেগুলো বুঝে ওঠার ক্লাস হলো 'ক্লাস নাইন'। তাইতো ক্লাস টেনে উঠেও এখন বারবার ক্লাস নাইনের দিনগুলো মনে পড়ে যায়। নস্টালজিক হয়ে পড়ি যখন ক্লাস নাইনের কোনো জুনিয়রকে ফিজিক্স কিংবা কেমিস্ট্রি বই নিয়ে একগাদা অভিযোগ করতে শুনি। ক্লাস টেনে ওঠার পর পড়ার চাপ এতটাই বেড়ে যায় যে আশেপাশের জগতের দিকে তাকানোর সময় বের করাও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তো ক্লাসের নাইনের মিষ্টি স্মৃতিগুলোই আমাদের একটু স্বস্তি দেয়, একটু ভালোলাগার খোরাক যোগায়। যারা ক্লাস নাইনে পড় বা ভবিষ্যতে পড়বে তাদের মধ্যেও কারো কারো অবস্থা নিশ্চয়ই আমার মতো হবে। কিন্তু ক্লাস নাইন আমাদের জীবনে বারবার ফিরে আসবে না। তাইতো সকলেরই উচিত অল্প সময়কে যতটা সম্ভব কাজে লাগিয়ে ক্লাস নাইনকে মনভরে উপভোগ করা। নাহলে একসময় আমার মতো তোমারও হয়ত বলতে ইচ্ছা করবে 'মিস ইউ, ক্লাস নাইন'।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com