মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায়ে জটলা

অষ্টম শ্রেণির পরই নির্বাচন করতে হয় নিজের পছন্দের বিভাগ যাতে একজন শিক্ষার্থী নিজের দক্ষতার যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও দেখা যায় নানান সমস্যা।
মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায়ে জটলা

বৈষম্যের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। এসব সমস্যার মূলে অনেকসময়ই দেখা যায় পরিবার, সমাজ, এমনকি রয়েছেন শিক্ষকরাও।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় শিক্ষার্থীদের যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তারা কোন বিভাগে পড়াশুনা করছে তখন প্রত্যাশিত উত্তরটি হয়ে থাকে বিজ্ঞান বিভাগ। বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক ও অন্যান্য বিভাগের তুলনায় ‘বিশেষ বিভাগ’ মনে করায় অনেক সময়ই শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাজ করে একধরণের মানসিক চাপ। 

আমার মতে পড়ালেখার ক্ষেত্রে সব বিষয় এবং বিভাগই সমান মর্যাদার অধিকারী কেননা জীবনে উন্নতি করতে হলে সব বিষয় ও বিভাগেই কঠোর অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকসময় আমাদের দেশের অভিভাবক, শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকদের মাঝে দেখা যায় পড়ার বিষয় ও বিভাগ নিয়ে বৈষম্য ও ভুল ধারণা।     

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জানায়, সে অষ্টম শ্রেণির শেষ থেকেই অধীর আগ্রহের সাথে মানবিক  বিভাগে পড়ালেখা করতে চাচ্ছিল। কেননা, ছোটবেলা থেকেই তার মানবিকে পড়ার অনেক ইচ্ছা ছিল এবং অষ্টম শ্রেণিতে জিপিএ পাঁচ পাবার পর মনে হয়েছিল মানবিকে খুব ভালো করতে পারবে। তবে তার বাবা ও মা এই রেজাল্ট দেখে মানবিক বিভাগে পড়তে দিতে চান না। তাদের মতে রেজাল্ট অনেক ভালো হলে কম ভালো ফল করেছে যারা তারা যে বিভাগে পড়ছে সে বিভাগে পড়াটা অর্থহীন। শেষে, তাকে বিজ্ঞান বিভাগেই পড়তে হচ্ছে।

ঠিক এরকমভাবে পিষ্ট হচ্ছে আমাদের সমাজের আরো অনেক শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন। কেননা, অশিক্ষত, স্বল্প শিক্ষিত, এমনকি শিক্ষিত মানুষের মাথায় ঢুকে পড়েছে এমন এক ভ্রান্ত ধারণা যে জীবনে বড় হতে হলে অবশ্যই বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে হবে।

কিছুদিন আগেই ক্লাসে পড়ার সময় যখন বিষয় শিক্ষককে বলতে শুনলাম, ‘তোমরা তো বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, তোমরা এই ব্যাপারটা আরো ভালোমতো বুঝবে।’ তখন কথাটি কানে এসে বিঁধলো। এভাবেই কি সৃষ্টি হচ্ছে সমাজের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল?   

কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যখন কেউ এসে পড়ালেখার বিভাগ সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন করে বসে, তখন বিজ্ঞান বিভাগ শুনলে অনেকেই খুশি হয়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন কোনো অনুষ্ঠান কিংবা কোনো প্রতিযোগিতার জন্য আমন্ত্রণ পৌঁছে দেয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বেশি।

বৈষম্যের সমাপ্তি এখানেই নয়, কিছুদিন আগে শুনলাম এক মা তার মেয়েকে বলছেন, “তুমি মেয়ে মানুষ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ে কি করবে? তারচে বরং তুমি বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করে ডাক্তার হয়ে যাও।’

এ মনোভাব একটি শিশুর মানসিক বিকাশ ও জীবনে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে কতটা নেতিবাচক বুঝতে অক্ষম এধরনের অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীর লিঙ্গের ফলে কিংবা বিশেষ কোনো বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে পরিবার থেকে শিক্ষার্থীর বিভাগ নির্বাচনে হস্তক্ষেপ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগ হারাবার একটি অন্যতম কারণ। এধরণের সমস্যা কারণ হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীদের পরের পরীক্ষায় বাজে ফলাফলের। 

মনোযোগ হারানো ছাড়াও, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় শিক্ষক ও সমাজের গড়ে তোলা বিভিন্ন বিভাগের ব্যবধান সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের মাঝে একপ্রকার দেয়াল সৃষ্টি করা হয়। আলাদা বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাঝে ভেদাভেদ করা হলে ফলস্বরূপ বিঘ্নতার  সৃষ্টি হয় তাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায়। এই ভেদভেদের ফলে নষ্ট হতে পারে পারস্পরিক বন্ধুত্ব, এমনকি সহানুভূতি।    

এই নীরব বৈষম্যের ফলে যেমন শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের বিভাগ বেছে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে ব্যর্থ হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানার্জন করতে। এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কেবল সচেতনতাই একমাত্র ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, এক্ষত্রে সচেতন হতে হবে অভিভাবককে, শিক্ষকককে এমনকি স্বয়ং শিক্ষার্থীকে। তাহলেই পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা। 

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com