তবে কি গাড়ি চাপাই আমাদের ভবিতব্য?

ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত বাবা মায়ের কাছে একটা কথা শুনে আসছি। কথাটা হলো, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’ তবে বাবা মায়ের এই মহা মূল্যবান কথাটাকে বিকৃত করে মজা করে বলতাম, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে।’
তবে কি গাড়ি চাপাই আমাদের ভবিতব্য?

কিন্তু মজার ব্যাপারটা হলো, বর্তমান পরিস্থিতির সাথে এই কথাটা একেবারে মিলে গেছে।

কারণ বর্তমান সময়ে আমাদের দেশ ছাত্রদের জীবনের মৌলিক নিরাপত্তাটুকুও দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যাদের চোখে দেশ সমৃদ্ধির আশার আলো দেখে, সেই আলো নিভে যাচ্ছে এক নিমিষে। সদ্য কলেজে ওঠা তরুণের দুটো স্বপ্নাতুর চোখ, দেশের অগ্রগতির কর্ণধার, বছরের পর বছর ধরে যত্নে বড় করে তোলা সন্তানকে নিয়ে অসংখ্য আশা থেঁতলে যায় বাসের চাকার নিচে। এর পরও কি চুপ করে থাকা যায়? চুপ করে থাকা যাবে না কেন?

সেজন্য আন্দোলন হচ্ছে। যথেষ্ট আন্দোলন হচ্ছে। আর আমি এই আন্দোলনকে সমর্থন করি। কেনই বা করবো না? নিজেদের নিরাপত্তা চাওয়া কোনো অপরাধ নয়। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আন্দোলন করছে। তারা এই দেশের সমস্ত মানুষের নিরাপত্তার জন্য আন্দোলন করছে। তবে আমি সেই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু কিংবা আন্দোলন নিয়েও তেমন বিশেষ কিছু বলবো না।

আমি বলবো আমার নিজের কথা। রাজধানী শহরে একজন যাত্রী হিসেবে আমি নিজে কতটা নিরাপদ? পড়ালেখার প্রয়োজনেই প্রিয় শহর আর বাবা মাকে ছেড়ে আমার ঢাকাতে আসা। মিরপুর এক এর রাইনখোলা থেকে প্রতিদিন বাসে উঠে আমায় ক্লাস করতে যেতে হয়। প্রতিদিন ওই একটা জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকি বাসের জন্য। এরপর অনেকটা হুড়োহুড়ি করেই বাসে চড়তে হয়। কারণ বাস বেশিক্ষণ অপেক্ষা করবে না। বাস কতটা ফিট, সেটা আমি ভাবি না। বাস ভাঙা হোক আর যাই হোক, আমাকে গন্তুব্যে পৌঁছতে হবে তো। ভাগ্য ভালো থাকলে বাসের ভেতর সিট পাই, আর ভাগ্য খারাপ থাকলে সেটাও পাই না। মাঝে মাঝে তো দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত পাই না। তবুও বাসের হেল্পাররা ভেতরে জায়গা আছে বলে বলে একের পর এক যাত্রী তুলতেই থাকে।

প্রত্যেক বাসে দেখি কিছু সংরক্ষিত সিট রয়েছে নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সেই সমস্ত সিটে বসে থাকতে দেখি মার্জিত পোশাক পরা সুদর্শন পুরুষদের। আমার মাঝে মাঝে সেই সমস্ত সুদর্শন যুবকদের বলতে ইচ্ছে করে, "আচ্ছা, আপনি শিশু নাকি প্রতিবন্ধী? "

গন্তব্যে পৌঁছানোর পর বাসের দরজার সামনে এগিয়ে আসি। হেল্পার ওদিক থেকে বলতে থাকেন, "হালকা বেরেক, হালকা বেরেক, যাত্রী নামার আছে।" ব্রেকটা সত্যিই হালকা ভাবেই ধরা হয়। কারণ বাসটা তখনও যথেষ্ট গতিতে সামনের দিকে এগোতে থাকে। ড্রাইভারেরা এক মিনিটের জন্যও বাস থামায় না। যখন বাস থেকে নামি, গতি জড়তার জন্য পুরো শরীর সামনে দিকে ঝুঁকে পড়ে। মনে হতে থাকে আর একটু হলেই রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে যেতাম।

আমার মতো কলেজ ছাত্রের এমন অবস্থা হয়, আমি ভাবে কিভাবে ষাটোর্ধ বৃদ্ধ কিংবা ছোট শিশুরা এই ঝোঁক সামলায়? তারাও তো বাসে চলাচল করেন। আসলে বর্তমানে তরুণ, শিশু, বৃদ্ধ কেউ নিরাপদ নয়। ঢাকা শহরে প্রত্যেকটি লেগুনাতে দুটো বা তিনটে করে শিশু কাজ করে। তারা পুরোটা দিন, লেগুনার বাইরে পেছনের দিকে ঝুলে ঝুলে যাতায়াত করে। আচ্ছা, কখনো যদি ওই সমস্ত বাচ্চাদের হাত একবার ফসকে যায়, তাহলে কি হতে পারে আমরা কি ভেবে দেখি কখনো?

দুদিন আগে ক্লাস করতে যাবার সময় কোনো বাস পাইনি, আন্দোলনরত ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করেছিল বলে। বাসায় ফেরার সময়ও প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আমি কোনো বাস পাইনি। বাসায় ফিরতে হয়েছে অনেকটা রাস্তা পায়ে হেঁটে। কিন্তু তবুও আমার দুঃখ নেই। ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আমিও অংশ হতে পারছি বলে। আজ আমি পায়ে হেঁটে পথ চলছি, কাল পুরো দেশবাসী যানবাহনে নিরাপদে তার গন্তব্যে যেতে পারবে।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com