কলেজ আর একাকীত্ব

দীর্ঘ ১০ বছরের হাসি-কান্নার ফুলঝুরি, বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ, আড্ডা, খুনশুটি পেছনে ফেলে সব মায়া ত্যাগ করে এবার নতুন জায়গায় একলা আমি।
কলেজ আর একাকীত্ব

জায়গাটি আমার নতুন কলেজ। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

হ্যাঁ, আজ আমার কলেজের প্রথম দিন। কলেজ অডিটোরিয়ামের এককোণে বসে আছি আমি। তবে সে আনন্দ ছাপিয়ে স্কুলজীবনের কথাই বারবার মনে পড়ছে।

মায়ের হাত ধরে প্রথম স্কুলে গিয়েছিলাম। একমাত্র ছেলে হওয়ায় মা চোখে হারাতেন। আমিও মাকে চোখের সামনে থেকে হারাতে দিতাম না। কিন্তু একদিন মা আমায় ঘুরতে যাবার নাম করে নতুন কাপড় পরালেন। এটা তো আমার নানু কিংবা দাদু বাড়ি নয়। তাহলে? তখনও আমি জানতাম না, যে এটাই হবে আমার স্কুল!  

চকোলেটের লোভ দেখিয়ে সুন্দর এক আপুর হাতে মা আমায় তুলে দিলেন। আমি তখনও বুঝিনি যে উনি আমার শিক্ষক। সে বুদ্ধিটুকু থাকলে হয়ত উনার সাথে সেদিনের নানান বায়না আর পাগলামি করতাম না। ছোট ছিলাম তো!

আমাকে একটা ক্লাসরুমে আনা হলো। সেখানে সবাই আমার বয়সী শিশু। আমার সিট হলো জানালার এক কোণে। আম্মু অনেক কথা আর আদর করে বিদায় নেওয়ার পর থেকে শুরু হলো আমার কান্না।

জানালা দিয়ে আম্মুর চলে যাওয়া দেখে কান্না আর থামছিল না। কিন্তু আম্মু আমার দিকে ফিরেও তাকাননি। সেদিন প্রথম তাকে আমার খুব পাষাণ মনে হয়েছিল। তবে আমি বড় হয়ে বুঝেছি কেন তিনি আমার দিকে তাকাননি।

এদিকে আমার কান্না থামাতে হেডম্যামও চলে আসেন তবুও কান্না থামার লক্ষণ না দেখে ফুলবানু মাসি আমায় কোলে করে দোকানে নিয়ে যান। সেখান থেকে কিনে দেন হরেক রকমের চকোলেট। এরপর আমি কিছুটা শান্ত হয়েছিলাম বলে ঝাপসা স্মৃতির মতো এখনও মনে পড়ে।

এসব ভাবতে ভাবতে আমি ডুব দিয়েছিলাম এক অতীত রাজ্যে। মাইকের শব্দে ফিরে এলাম চকোলেটের স্মৃতি থেকে। মাইকে বলা হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে প্রিন্সিপাল স্যার উপস্থিত হবেন। সবাই ভদ্রভাবে থাকো।
পরিচিত কাউকে দেখছি না। খুব বোরিং লাগছে, সাথে ভয় আর অস্বস্তি।

হঠাৎ আমার কয়েক সিট পেছনে কোচিংয়ের বন্ধু সাব্বির, নাঈমকে দেখলাম। কাকতালীয় ঘটনা। তাদের পেয়ে একাকীত্বের কষ্ট খানিক কমল।

প্রিন্সিপাল স্যার এলেন। অনুষ্ঠানের ইতি টানা হলো প্রিন্সিপাল স্যারের বক্তব্য দিয়ে। প্রিন্সিপাল কর্ণেল মনির স্যার অনেক উপদেশের মাঝে একটা কথা সব সময় মনে থাকবে তা হলো, ‘জিপিএ৫-এর কোনো মূল্য নাই যদি তুমি ভালো মানুষ হতে না পারো। সফলতা থেকে মূল্যবোধ কম অমূল্য সম্পদ নয়। ভালো মানুষ হও, চরিত্র সুন্দর কর তবে তুমি ভালো ছাত্র হবে। জিপিএ৫ মানেই ভালো ছাত্র নয়।'

এরপরে একে একে নাম ডাকা শুরু হলো। আমার নাম ডাকা হলে বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। হেঁটে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য এগিয়ে যেতে পারছিলাম না। কেন জানি পা কাঁপছে। জানি না কেন। ক্লাস শিক্ষকের নিদের্শে তাকে অনুসরণ করলাম আমরা প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী। স্যার আমাদের সম্পূর্ণ ক্যম্পাসটা ঘুরিয়ে দেখালেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন কলেজে নিয়োজিত ডাক্তার, প্রকৌশলী, নিরাপত্তা প্রহরী, সবার সাথে।

ক্যাম্পাসটার সৌন্দর্য দেখে মন অনেকটা ভাল হয়ে গেল। ক্লাসে বসে কলেজের নিয়ম কানুন সব জানলাম। নিয়মকানুন শুনে সেই স্কুলের প্রথম দিনের মতো কাঁদতে ইচ্ছা করছে। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ক্লাস শুরু হবে। আঁতকে উঠলাম শুনেই। স্যার আশ্বস্ত করলেন, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

স্যাররা প্রায় সবাই বেশ ফ্রেন্ডলি। আর ক্লাসটিচার আমাদের বলে দিয়েছেন, শিক্ষককরা শুধু তোমার স্যার নন, এরা তোমার ভাই, মা-বাবা সব। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

সহপাঠীদের সঙ্গে আলাপ হলো। তাদের মাঝখান থেকে কয়েক জনের সাথে বেশ ভাবও হল। এভাবে কলেজ জীবনের প্রথম দিন শেষ হল।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com