সব ভেস্তে গেল

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে পাবো পড়ালেখা না করার অপার স্বাধীনতা। ঘুরে বেড়াব কোথায় কোথায় তার পরিকল্পনাও ছকে রেখেছি। কিন্তু বিধি বাম!
সব ভেস্তে গেল

সড়ক দুর্ঘটনায় আমার পা ভেঙে সব ভেস্তে গেল!

ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ করে সিএনজি অটো রিকশায় বাড়ি ফিরছিলাম। বাসার কাছে এসেই বিকট শব্দে গাড়িটির সামনে চাকা খুলে যায়। আমি সামনের ডানদিকে বসা ছিলাম। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িটিও ডানদিকে পড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে আমার ডান পা গাড়িটির নিচে চাপা পড়ে আর ডান হাত ও মাথায় খুব চোট পাই।   

বাকী যাত্রীদের বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার। আমার মনে হচ্ছিল পা'টা কে যেন কেটে নিয়ে যাচ্ছে। দুইবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চাকার নিচ থেকে আমার পা বের করতে পারিনি। 

পরে কয়েকজন পথচারী এসে গাড়িটি রাস্তার ওপরে তুলে সোজা করলেন। চাপা পড়া ডান পায়ের অবস্থা প্রথম দেখাতেই শিউরে উঠলাম। ডান পায়ের ব্যথার সাথে সমস্ত শরীরের ব্যথা আমাকে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলছিল।

কয়েকজন দয়ালু পথচারী আরেকটি রিকশায় আমাকে উপজেলা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।

আব্বুও খবর পেয়ে হাসপাতালে এলেন। আমাকে কোলে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলেন। তখন বিছানায় শুয়ে চেষ্টা করেও ডান পা সোজা করতে পারছি না। এমন বেঁকে গেছে, দেখতে ভয় লাগছিলো। সেই সাথে সমস্ত শরীর কাঁপছে। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বললেন উন্নত চিকিৎসা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। 

আব্বু অ্যাম্বুলেন্সে আমাকে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। আম্মু মোবাইলে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে ধৈর্য রেখো। কিন্তু আমার মাথায় দুশ্চিন্তা আর ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ডান পা দিয়ে হাঁটতে পারবো? পা কি কেটে ফেলা হবে, ইত্যাদি।    

সিলেটে ওসমানী মেডিকাল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আমাকে অর্থপেডিক ওয়ার্ডে নেওয়া হয়। ডাক্তাররা স্যালাইন দিলেন ও এক্সরে করানোর জন্য বললেন। সিলেটে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে দুজন মামাও রাতে এলেন। তারা এক্সরে রুমে নিয়ে গেলেন আমাকে।

ডান পা ও ডান হাত এক্সরে করা হয়। মাথার আঘাতটা ততটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এক্সরে করার সময় ডান পা ও ডান হাত সোজা করে রাখাটা আমার জন্য কষ্টকর ছিল। পায়ের ও হাতের ব্যথায় পুরোপুরি কেঁদে ফেলেছিলাম। এক্সরে রিপোর্টে দেখা গেলো, ডান পায়ের হাঁটুর ওপরের হাড় ভেঙে গেছে।

রাতেই অপারেশন হবে জানতে পারি। আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। হাঁটুর নিচে ইনজেকশন দিয়ে ছোট একটি রড পায়ের একপাশ দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যপাশে বের করা হয়। ব্যথায় তখন আম্মু, আম্মু বলে চিৎকার করেছিলাম।  

অপারেশন শেষে ওয়ার্ডের বিছানায় নেওয়া হয়। দেখলাম, পায়ের রডে রশি দিয়ে নিচে ইটের সাথে বাঁধা হচ্ছে। তখন পায়ে খুব বেশি ব্যথা করছিল। ভাবলাম অপারেশন শেষ হলে নিশ্চয় আস্তে আস্তে ব্যথা হয়ত কমে যাবে।

কিন্তু, না। ভাঙা হাড় আরও বেঁকে না যাওয়ার জন্য আর অন্য কি যেন কারণে হাঁটুর নিচে রড ঢুকিয়ে টানা দেওয়া হয়েছে। আসল অপারেশন বাকি আছে, কয়েকদিন পর হবে।

বাসার সবকিছু গুছিয়ে আম্মু হাসপাতালে এলেন। আমরা হাসপাতালের কেবিনে উঠলাম। অন্য সব ব্যথা কমলেও ডান পায়ের ব্যথা কোন ভাবেই কমছে না। ওষুধ চলছে। সবাই দেখতে আসছেন। বই পড়ে আর ফোনে আড্ডা দিয়ে আট দিন কেটে গেলো। তবে ডান পায়ের ব্যথাটা সব সময় আমার সঙ্গী হয়েই ছিল। নয় দিনের দিন অপারেশনের তারিখ। রাত বারোটার পর পানি ছাড়া কোনো কিছু খাওয়া যাবে না।

অপারেশান থিয়েটারে ঢোকার আগে আব্বু আম্মু অনেক বোঝালেন। কোনো ব্যথা টের পাবো না তাও বলে দিলেন। তবু খুব ভয় পাচ্ছিলাম। ডাক্তাররা আলাপ করতে করতে মেরুদণ্ডে ইনজেকশন দিলেন বোধ হয়।

আস্তে আস্তে পা দুটো অবশ হয়ে গেল। কি হচ্ছে কিছুই বিঝতে পারছি না। প্রায় তিন ঘন্টার বেশি সময় ধরে এই অপারেশন করেন তারা।

অপারেশনের পর পোস্ট অপারেটিভ রুমে নেওয়া হয়। আম্মু আব্বু দেখতে এলেন। সন্ধ্যায় কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়। পা তখনও অবশ হয়ে রয়েছে।

যত সময় যাচ্ছে ভাঙা পায়ের ব্যথা বাড়ছে।

দুর্ঘটনার এক মাসের বেশি সময় অতিক্রম করছি। আশার কথা, ডান পায়ের অবস্থা উন্নতির দিকে। এখন আর আগের মতো ব্যথাও নাই। নাই তেমন দুশ্চিন্তা, কেননা মাস খানেক পর আমি সেই আগের মতো হাঁটতে পারব। ইয়া হু! যদিও আমার ডান পায়ে কোমরের নিচ থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত হাড়ের সাথে পাত ও তিনটি স্ক্রু লাগানো হয়েছে। কয়েক বছর পর তা আবার অপারেশনের মাধ্যমে খুলতে হবে।

কষ্ট আর ব্যথা নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতাই অর্জন করছি। অর্জনের মধ্যে আম্মু-আব্বুর চোখে পানি দেখাটা সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। তবে নিশ্চয়, তাদের দোয়ায় এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com