ইংরেজির বড়াই

‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি ভাষার পত্তন’ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রত্যেক দেশের মানুষেরেই একটি নির্দিষ্ট ভাষা রয়েছে, নির্দিষ্ট সংস্কৃতি রয়েছে। তবে আজ আমরা অনেকেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছি। বর্তমানে নিজ দেশের সংস্কৃতি ও ভাষার তুলনায় আমরা অন্য দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি মেনে চলতে বেশি ভালোবাসি, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি!
ইংরেজির বড়াই

আমাদের সমাজের অনেক অভিভাবকের ধারণা, ‘শিশু ইংরেজি বলতে না পারলে, সেই শিশুটি পিছিয়ে গেল।’ শিশুকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করার জন্য আজও অভিভাবকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার শেষ নেই!

মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের মতো এই বিশ্বে কোনো জাতিকে এত সংগ্রাম, লড়াই করতে হয়নি, অথচ আমরা অনেকেই আজও আমাদের মাতৃভাষাকে সম্মান করি না, মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেই না।

আমাদের দেশের অনেক শিশুরাই ছোট থেকেই মায়ের কোলে বসে আমেরিকা-ইংল্যান্ডের স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করে! যদি ছোট থেকেই শিশু ভিনদেশি নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাহলে কী করে শিশুর মনে তার মাতৃভূমির জন্য, নিজ দেশের মানুষ ও সংস্কৃতির জন্য ভালোবাসা জন্মাবে?

আমাদের দেশের এমন অনেক শিশুই রয়েছে যারা কিনা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে চেনে না। রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতি চেনা তো দূরের কথা! অথচ তাদেরকে ইংরেজি বা হিন্দি গানের কথা বা গায়ক, গায়িকাদের নাম বলা হলে প্রায় অনেকেই তাদেরকে চেনে। তাহলে আমরা আসলে কী শিখছি? নিজ দেশের সংস্কৃতিকেই তো আমরা পুরোপুরিভাবে জানতে ব্যর্থ হচ্ছি।

অনেকের কাছে শুনেছি রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি যারা শোনে তারা নাকি পুরান যুগের মানুষ। আধুনিক মানুষ নয়। যাদের এমনটা ধারণা তাদের কাছে আমার প্রশ্ন হলো, নিজ দেশের গান, দেশের সংস্কৃতিকে জানতে হলে কী কোনো সময়ের প্রয়োজন হয়? 

আসলে আমাদের দেশের অনেক শিশুই ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষার তুলনায় ইংরেজি ভাষার সাথে বেশি পরিচিত থাকে। দেখা যায় যে ছোট থেকেই তাকে বলা হয় যে, ‘এটা একটা ম্যাংগো।’ কিন্তু তখন তাকে বলা হয় না যে এটাকে বাংলায় ‘আম’ বলা হয়। এর ফলে এই শিশুটি যখন বড় হয় তখন সে এই আমটিকে ‘ম্যাংগো’ নামেই চেনে।

এ নিয়ে আমার একটা মজার ঘটনা রয়েছে। আমাদের দেশের অনেক শিশুরাই মা-বাবাকে ‘মাম্মি’ বা ‘পাপা’ বলে থাকে। কিন্তু আমি কখনোই এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত ছিলাম না। ছোট থাকতে আমাদের বাসায় যখন কোন অতিথি আসত আর তাদের ছেলে-মেয়েরা তাদেরকে ‘মাম্মি’ বা ‘পাপা’ বলে ডাকত, তখন আমি এই শব্দগুলোর অর্থ না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে মার দিকে তাকিয়ে থাকতাম!

আসলে আমাদের সমাজে যেসব মানুষের ধারণা ইংরেজি না পারাটা অযোগ্যতা তাদের কাছে আমার প্রশ্ন হলো, নিজের মাতৃভাষা না জেনে অন্য দেশের মাতৃভাষাকে আয়ত্ত যারা করে, তারা আসলে কতটা যোগ্য?

যদি শিশু হয়ে খুব বেশি লিখে ফেলি তাহলে ক্ষমা করবেন। ইংরেজি শেখার বিপক্ষে আমি নই কিংবা কোনো ভাষাকে হেয় করা আমার লেখার উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু চোখের সামনে যখন দেখি যে একটি শিশু শুদ্ধভাবে ইংরেজি পড়তে পারছে, ইংরেজিতে কথা বলতে পারছে, অথচ নিজ দেশের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারছে না, দেশের সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন সত্যিই খুব কষ্ট হয়। আর শিশুদেরকে এ অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন অভিভাবকদের সহায়তা।

একটি শিশু যদি তার নিজের দেশকে, নিজ দেশের সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে চিনতে না পারে, জানতে না পারে তাহলে তার দেশপ্রেম তৈরি হবে না, এটাই স্বাভাবিক। একটি শিশুর দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য সবচেয়ে জরুরি তার পারিবারিক পরিবেশ ও পরিবারের সাংস্কৃতিক মনোভাব। দেশে-কিংবা দেশের বাহিরে চলতে হলে আমাদের অবশ্যই ইরেজি জানতে হবে। কিন্তু তাই বলে নিজ দেশের ভাষাকে ছোট করে নয়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com