এত স্বপ্নভঙ্গের দায় কে নেবে?

অনেকদিন পর এমন একটি পরীক্ষা হলো যেখানে একটা প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন সফলতা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
এত স্বপ্নভঙ্গের দায় কে নেবে?

শুধু তাই নয়, এইবার পরীক্ষা পরিচালনাও করা হয়েছে অনেকটা নিয়মের বাড়াবাড়ির মধ্যে দিয়ে।

বাড়াবাড়ি বলছি কারণ পরীক্ষা চলাকালীন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর আত্মহত্যার কথা শুনে। তারা কেন আত্মহত্যা করল? পরীক্ষার চাপে? নাকি অন্য কারণ তা খুঁজব না।

কিন্তু এই পরীক্ষাই দায়ী কিনা আসুন একটু ভেবে দেখি। গোড়া থেকে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা যাক।

প্রথমেই যে বিষয়টা সামনে আসে, তা হলো সময়। একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী যেখানে সিলেবাস শেষ করার জন্য সময় পায় ২৪ মাস, সেখানে একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী তার সম্পূর্ন সিলেবাস শেষ করতে সময় পায় মাত্র ১৮ মাস। এই সিলেবাস এসএসসি পরীক্ষার সিলেবাসের তিন থেকে চার গুণ। হয়তো এর বেশিও হতে পারে। এমনকি কলেজগুলোও এই বিশাল সিলেবাস শেষ করতে অনেকটা হিমশিম খেয়ে যায়।

আমাদের সব সময় শেখায় পড়ালেখার বাইরেও খেলাধুলা এবং অন্যান্য যাবতীয় সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে অনেকেই উৎসাহিত করেন। কিন্তু একজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কিভাবে এত বড় সিলেবাসের বোঝা মাথায় নিয়ে এসব সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেবে?

এবার আসা যাক এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের রুটিনে। পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার আগে ছুটি মাত্র একদিন। একদিনে কি আদৌ এই বই সম্পূর্ন রিভিশন দেওয়া সম্ভব? তবুও একজন ছাত্র হয়তো কিছুটা কষ্ট করলেই পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র অনেকটাই আয়ত্ব করতে পারবে।

কিন্তু রসায়ন দ্বিতীয় পত্রের আগেও ছুটি ছিল মাত্র একদিন। রসায়নের জৈব রসায়ন অধ্যায় রিভিশন করতেই পুরো একদিন প্রয়োজন। তাহলে অন্য অধ্যায়গুলো কখন দেখবে একটা ছাত্র? আর গণিত প্রথম পত্রের আগে ছুটি মাত্র একদিন। এই বিষয়ে অঙ্ক সংখ্যা মোটামোটি ১২০০ এর বেশি। একটা ছাত্র যদি বেছে বেছেও এই অঙ্ক শেষ করতে চায়, তাহলেও অন্তত তিনদিন সময় লাগবে। সেখানে একদিনের ছুটি আদৌ কি মানায়? এতটা দ্রুত পরীক্ষা শেষ করতে পারা কী আপনাদের সাফল্যের মধ্যে পড়ে? তা পড়লে পড়ুক। কিন্তু শুধুমাত্র রিভিশন দিতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা খারাপ দেয়। এতগুলো স্বপ্ন ভঙ্গের দায়ভার কে নেবে?

কত ছাত্র বাসায় যেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে, তার ইয়ত্তা নেই। একটা প্রশ্নপত্রের সাথে যে কতগুলো দেশ গড়ার কারিগরের স্বপ্ন জুড়ে আছে তা হয়তো বোঝানোও সম্ভব নয়।

আমি নিজেও একজন পরীক্ষার্থী। পরীক্ষাকালীন আমার কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে সে বিষয়গুলোই তুলে ধরছি।

পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে আমাদের বলা হয়েছে পরীক্ষা শুরু হবার ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে পৌঁছাতে। একটু দেরি হলেই করতে হচ্ছে জবাবদিহি। বাসা থেকে অনেক আগে রওনা দিয়েও যানজট ও রিকশা না পাওয়ায় দু চার মিনিট দেরি হলেও শুনতে হয়েছে নানা কথা। এটা শুধু যে আমার সঙ্গে হয়েছে তাই না। সামাজিক মাধ্যমে অনেকের ফেইসবুক পোস্টেই দেখেছি তারাও হলে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন।

আমাদের কেন্দ্র থেকে বলে দেওয়া হয়েছে কোনো রকম হার্ডবোর্ড নেওয়া যাবে না। তাহলে একটা ছাত্র অসমতল বেঞ্চে কী করে পরীক্ষা দেবে? বিশেষ করে বহুনির্বচনীতে বৃত্ত ভরাটের সময় ওএমআর শিট ছিদ্র হয়ে যাবারও সম্ভাবনা থাকছে।

আমাদের প্রথম দিকে বলা হয়েছিল ডিজিটাল ঘড়ি নিয়ে আসা যাবে না। আমরা সেই কথামতো এনালগ ঘড়ি নিয়ে পরীক্ষার কক্ষে যাই। তারপর একদিন হঠাৎ করেই বলা হলো, কোনো ঘড়িই পরীক্ষার কক্ষে আনা যাবে না। ৪০০ টাকা মূল্যের এনালগ ঘড়ি কী করে একটা ছাত্র পরীক্ষায় কারচুপি করার জন্য ব্যবহার করে তা এখনো আমার বোধগম্য নয়। যদিও একটা দেওয়াল ঘড়ি ছিল সেটা কার কার উপকারে এসেছে জানি না তবে আমার মতো চশমা পড়া চার চোখওয়ালা ছাত্রও সেই দেয়াল ঘড়ির কাঁটা দেখতে পাইনি আমি নিশ্চিত।

তবুও পরীক্ষা শেষ হলো। এর ফলাফলের সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার স্বপ্নের সম্পৃক্ততা। জানি না ফল প্রকাশের দিন আর কাকে কাকে হারাতে হবে। দুঃখ হয় কেউ ছাত্রদের বোঝে না। আমরা কীভাবে বেঁচে থাকি কেউ বুঝতে চায় না। এরকম শিক্ষা ব্যাবস্থা আমাদেরকে খাঁচায় বন্দী পাখি বানিয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার ধোঁয়াশা কাটছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এর একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের অনুভূতিহীন যন্ত্র মানবে পরিণত করা।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com