সে এক রূপকথার শহর

সবাই বলে আমি নাকি এখন জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় পার করছি। সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। পেয়ে গেলাম এক বড় ছুটি। আর এই ছুটিতে কেবল বাসায় বসে পড়ব, তাতো হতে পারে না। তাই সুযোগ খুঁজছিলাম, কোথায় যাওয়া যায়? ঢাকার পরিবেশে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে।
সে এক রূপকথার শহর

হঠাৎ রাতের বেলা ভাইয়া বললেন, “হিমেল কাল নারায়ণগঞ্জ যাব।”

আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললাম, তাই নাকি! হঠাৎ সেখানে যাবে কেন?

বলেন, “বন্ধুরা মিলে পানাম নগর যাব। যেটি প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁতে। আর তুইও যাবি আমাদের সাথে। গিয়ে দেখে আসবি পানাম নগর। অনেক ভালো লাগবে দেখবি।”

ব্যস পেয়ে গেলাম সুযোগ! এতদিন কেবল "বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়" বইয়ে পড়েছি প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও এর শহর পানাম নগর সম্পর্কে। কাল সেখানে যাবো ভাবতেই কেমন যেন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিল। কেননা, পানাম নগর পৃথিবীর একশটি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের মধ্যে একটি। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফাউন্ড ২০১৬ এটিকে ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় যোগ করে।

এক সময় ধনী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাস ছিল এখানে। ছিল মসলিনের জমজমাট ব্যবসা। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো ভবন রয়েছে, যা বাংলার বার ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর।

জানা যায়, ১৪০০ শতাব্দীতে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে পৃথিবীর নামি-দামি শিক্ষকরা পড়াতে আসতেন।

এ জায়গায় ঘোরার সুযোগ নিঃসন্দেহে বেশ ভালো। বেশি রাত না জেগে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর ছটায় ভাইয়া ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন। এক লাফে উঠে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিলাম আর সঙ্গে নিলাম জন স্টাইনবেক এর ‘দ্য পার্ল’ ও সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’ এবং কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। বাসা থেকে ভাইয়ার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। বাসে করে ফার্মগেট গিয়ে ভুনা খিচুরি দিয়ে নাস্তা করে ভাইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখি সেখানে তার অন্য বন্ধুরাও এসে গেছে। তাদের সাথে পরিচিত হলাম।

তাদের একজন বললেন, “তুমিতো এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছো, কাজেই জীবনের সবচেয়ে বড় ছুটিতে আছ। বাসার সবাই বলবে, ‘পড় পড়। কিন্তু পড়বে না। কেবল খাবে, ঘুমাবে, ঘুরবে আর গল্পের বই পড়বে।” 

কথাগুলো শুনে বেশ মজাই পেলাম। সেখান থেকে আমরা আটজন বাসে উঠে গুলিস্তান গেলাম। সেখান থেকে বাসে উঠলাম নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার জন্যে। যেহেতু শুক্রবার তাই রাস্তা প্রাই ফাঁকাই ছিল। কিন্তু খানিক বাদে সব যেন পাল্টে গেল! আমরা জ্যামের ভেতর পড়লাম। খুব বিরক্তই হচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল আমার সাথে তো বই আছে! কাজেই, বিরক্ত হবার প্রশ্নই আসে না। ব্যাগ থেকে সমরেশ মজুমদারের "উত্তরাধিকার" বইটা বের করে পড়তে শুরু করলাম। খানিক বাদেই সমরেশ মজুমদারের মননশীল সাহিত্যে আমি আবারো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পরেই বাস চলতে শুরু করল। সামনে দেখলাম মেওর  হানিফ ফ্লাইওভার তারপর হঠাৎ দেখি পাশে একটি নদী যার চারপাশ কারখানায় ভরপুর। শীতলক্ষ্যা নদীকে চিনতে আর সময় লাগলো না। আবার মনটা খুব খারাপও লাগলো। কেননা, আজ শীতলক্ষ্যা আর বুড়িগঙ্গার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই দূষিত।

যাই হোক, প্রায় এক ঘণ্টা পরে আমাদের বাস সোনারগাঁ এসে পৌঁছাল। সেখান থেকে বোরাকে করে আমরা পানাম নগরে গেলাম। টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করেই দেখলাম, পাশে বাংলা ও ইংরেজিতে পানাম নগরের ইতিহাস লেখা রয়েছে। সেটি পাড়লাম  আর মুগ্ধ হলাম।

পানামের মূল রাস্তায় এসে সামনে তাকিয়ে আমি যেন অবাক হলাম। কেননা পানাম নগরী নিখুঁত নকশার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। পানাম নগরীর দুই ধারে ঔপনিবেশিক আমলের মোট ৫২টি স্থাপনা। যেখানে দেখা যায় অপূর্ব ও নিপুণ কারুকার্যখচিত প্রাচীন সব দালানকোঠা। সরু রাস্তার দুই পাশে অট্টালিকা, সরাইখানা, ঠাকুর ঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, প্রশস্ত দেয়াল জানান দেয় এ নগরের প্রাচীন সমৃদ্ধির কথা। স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সাথে মোঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ বেশ লক্ষণীয়। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভবনের উপরে উঠা নিষেধ।

কিন্তু লোভ সামলাতে পারলাম না। সবাই মিলে একটি ভবনের উপর উঠলাম। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা খুব সরু ও অন্ধকার ছিল। মনে হলো আমি ফেলুদার মতো অভিযানে যাচ্ছি। কিন্তু উপরে উঠেই সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। কেননা, দোতলার কংক্রিটের মেঝেতে অনেক বড়সড় এক গর্ত হয়ে আছে। কোনো রকমে গর্তটা পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরটা ফাঁকাই ছিল। কিন্তু উপরে তাকিয়ে যেন খানিকটা হোঁচট খেলাম। কেননা, ভবনের ছাদ, দেয়াল, পাটাতনগুলো আসলেই অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। সবাইকে ডেকে সতর্ক করলাম, কেননা আমরা আটজন এরকম একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে আছি। আমরা সহসাই ভুল বুঝতে পারলাম আর তাড়াতাড়ি নেমে পরলাম। নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। মনে মনে নিজেকে বোঝালাম, নিষেধ অমান্য করাটা ভুল।

কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, দশনার্থীরা পুরনো ঐতিহ্যে ভরপুর স্থাপনা দেখার বদলে কেবল অভিনব সব অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তুলছে। যেন তারা কেবল ফেইসবুকে আপলোড দেওয়ার ছবি তুলতেই এখানে এসেছে।

যাইহোক, সবকিছু দেখে যেমন ভালো লাগলো ঠিক তেমনি কিছু কিছু বিষয় খুব খারাপ লাগল। যেমন, শত বছরের পানাম নগর হারাতে বসেছে তার ঐতিহাসিক রূপ, সৌন্দর্য ও জৌলুস।

এই নগরের অনেক প্রাচীন স্থাপনাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলোর অবস্থাও জরাজীর্ণ। শোনা যায় প্রায় দশ বছর আগে এ নগর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা স্থগিত হয়ে যায়। নগরের পুরনো ভবনগুলোর ইট, সুরকি ধসে পড়ছে। ভবনের দখল নিয়েছে শেওলা ও আগাছা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ভুঁতুড়ে বাড়ি। তাই এগুলো এখন বিলীন হওয়ার পথে।

পুরো এলাকাটি ঘুরে খুব ভালো লাগলো। অবশেষে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। ফিরতে ফিরতে লিন ইউতাং এর কথাটি মনে পড়ল।

তিনি বলেছেন, “ভ্রমণ শেষে নিজ বাড়িতে ফেরার আগে পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারে না ভ্রমণ কতটা সুন্দর ছিল।"

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com