মে মাসের মাঝামাঝি সময়। আবহাওয়াটাও ছিল খুব ভালো। সে দিন বেশ সকাল সকালই রওনা হই আমরা। ১০টা না বাজতেই আমরা সবাই পৌঁছে যাই মংলাতে। সেখান থেকে যেতে হবে নদীপথে।
মংলা ফেরি ঘাট থেকে ইঞ্জিন চালিত একটি নৌকা ঠিক করেন মামা। সবাই উঠে পড়লে ট্রলারটি চলতে শুরু করে সুন্দরবনের করমজলের উদ্দেশে। সেখানে দেখলাম হরিণ, বানর আর নানা রকম পাখপাখালি। দেখলাম কেওড়া, গোলপাতা, সুন্দরী আর কত কত গাছপালা।
বনের ভেতর কিছুটা হেঁটে আমরা আবার উঠে পড়ি ট্রলারে। তখন খাঁ খাঁ রোদ। ট্রলারের উপর একটা কাপড় টানিয়ে আমাদের ছায়ার ব্যবস্থা করে দেন মাঝি ভাই। তারপর তার নৌকায় করেই ঘোরাঘুরি।
দুপুরের খাবারও আমাদের সঙ্গেই ছিল। পশুর নদীর ওপর নোয়কায় বসেই দুপুরের খাওয়াদাওয়া।
খাওয়া প্রায় শেষ, আকাশে সামান্য মেঘ করে। মাঝি ভাই মাথার ওপরে বাঁধা কাপড়টা খুলে ফেলেন। আর বলেন, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে!
আমরা সবাই অনেক মজা করছিলাম। তাই কেউ ফিরতে চাইছিলাম না। কিন্তু মাঝি ভাই হঠাৎ অনেক জোরে নৌকা চালিয়ে দেন ঘাটের দিকে।
আমরা কেউ ফিরতে রাজি না হওয়াতে মামা ট্রলারটি না ফিরিয়ে সামনে দিকে আরও যেতে বলেন। কিন্তু মাঝি ভাই কারো কথাতেই কান দিলেন না।
মনে আছে, মামা বেশ কয়েক বার ধমক দিলেও কোন কথা না বলেই মাঝি ভাই মংলা ঘাটের দিকেই ফিরতে থাকেন।
মুহূর্তেই মেঘে ঢেকে যায় পুরো আকাশ। কিছুক্ষণ আগে ঝিকমিক করতে থাকা পশুর নদীর পানিও যেন কেমন কালো দেখাচ্ছিল। আস্তে আস্তে বাতাসের গতিও বাড়তে শুরু করলো।
আমরা তখন পশুর নদীর ঠিক মাঝখানে। শুরু হয় ঝড়। আমরা সবাই খুব ভয় পাই; কান্নাকাটি করতে থাকি। ঝড়-বাতাস বাড়তে থাকে। আমার মনে হচ্ছিল আর মনে হয় তীরে পৌঁছানো হবে না।
তখন মঝি ভাই বলেন, ঝড়টা শুরু হওয়ার আগে আমি আপনাদের পৌঁছে দিতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু পারলাম না।
তখন মামা লজ্জিত কণ্ঠে বলেন, এতো সামান্য মেঘে যে ঝড় হবে আপনি বুঝলেন কী করে। আর তখন বলেন নি কেন?
মাঝি ভাই তখন তার কিছু অভিজ্ঞতার সাথে এটাও বললেন, জানলে আপনারা ভয়ে উত্তেজিত হয়ে যেতেন। তাই বলিনি।
অনেক কষ্টে মাঝি ভাই আমাদের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে মংলা ঘাটে পৌঁছান। মংলা পৌঁছানোর প্রায় এক ঘন্টা পর ঝড় থামে।
সে দিন সৃষ্টিকতার দয়ায় আর ওই মাঝি ভাইয়ের অভিজ্ঞতায় আমরা সবাই সুস্থ ভাবে ফিরে আসতে পারি। আমি আজও সেই মাঝি ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ।