শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

শিক্ষামন্ত্রী, আপনি ভালো আছেন? আপনাকে আমার অনেকগুলো অভিযোগ ও অনুরোধ করার আছে। সামনা সামনি বলতে পারলে ভালো লাগত। সেই সুযোগ নাই, তাই এই চিঠি।
শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

কবছর ধরেই সর্বস্তরের মানুষ প্রশ্নফাঁস আর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনাকে যখন অভিযুক্ত করছে, নিশ্চয় ব্যাপারটি আপনারও ভালো লাগছে না।

হ্যাঁ, আপনিও হয়ত আঁচ করছেন, আমাদের রাষ্ট্র অন্য অনেক দিক থেকে এগিয়ে গেলেও শিক্ষা, মূল্যবোধ, সততা আর দায়িত্বের জায়গাগুলোতে পিছিয়ে।

আমাদের অভিভাবক, শিক্ষক, আর আমলাদের একটা অংশ, এমনকি শিক্ষার্থীরাও যখন অন্যায়ে জড়িয়ে যায় তখন শুধু আপনিই দায়ী, বলতে দ্বিধা হয়।

দশের লাঠি, একের বোঝা, সেটা আমরাও জানি এবং বুঝি। কিন্তু শিক্ষা সংকট নিয়ে আপনাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলতে পারি? অন্য মন্ত্রীর কাছে তো এর প্রতিকার চাইতে পারি না। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর আপনি সেই মেরুদণ্ড সোজা রাখার দায়িত্বে আছেন। তাই আপনাকেই বলছি।  

নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় পঞ্চম শ্রেণি থেকেই পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হয়! সেটার ভালোমন্দের ব্যাপারে আমাদের কোনো রায় চাওয়াও হয় না।

এরকম তিনটি পরীক্ষায় বসার পরে কদিন আগেই বসেছিলাম উচ্চ মাধ্যমিকে। পরীক্ষার আগের রাত কিন্তু শুয়ে, বসে, পড়ে কাটাতে পারিনি আমি। প্রশ্নের জন্য ক্ষণে ক্ষণে মনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। চোখের সামনে দেখছি আমার বন্ধুরা প্রশ্ন পেয়ে সেই ফাঁস প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে।

হয়ত সে ভালো রেজাল্ট করবে, ভালো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে, সামাজিক সম্মান ও অর্থনৈতিকভাবে জীবনে সফল হবে। তবে আমি কেনো বঞ্চিত হব? 

নৈতিকতা ও সততা থেকে সরতে না পেরে পেয়েছি ‘গাধা’ তকমা! 

প্রকৃত মেধাবী ছাত্রটিও আজ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারে না, আমি জিপিএ পাঁচ পেয়েছি। কারণ অনেকেই বলে, পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিলে জিপিএ পাঁচ কেনো, ‘জিপিএ ছয়’ও পাওয়া যায়।

আপনার জন্য কষ্টই হয়। প্রায়ই আপনাকে বিতর্কিত হতে হয়। হতে হয়, সংবাদের শিরোনাম। আর সেটা মোটেও সুখকর সংবাদ হয় না আপনার জন্য। আর তারপর যখন আপনি বলেন যে, শক্ত হাতে, কঠোর হাতে প্রশ্নফাঁস ইত্যাদি দমন করবেন। আশা জাগে মনে। কিন্তু যেসব পথ দেখান, তা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয় না।

আপনি বলেছেন ফটোকপির দোকানে গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে। একবার বলেছেন, শিক্ষার্থী জড়িত থাকলে তার পরীক্ষার ফল বাতিল হবে। চলতি বছর জানালেন, প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। এসব কী আপনার মতো একজন দ্বায়িত্ববান মানুষের দেওয়া সমাধান বলে আপনার মনে হয়?

আপনি নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে কিছু অসাধু শিক্ষক জড়িত। কোচিং সেন্টার ও ফেইসবুক বন্ধেরও উপায় খুঁজেছেন। কিন্তু ফেইসবুক বন্ধ করলেই কী সমাধান আসবে? প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পরেই তো তা ফেইসবুকে আসে!

আর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি তো এতটা সয়ম্ভু নয় যে, কোচিং ছাড়াই আমরা নিজেদের প্রস্তুত করে তুলতে পারব। 

প্রশ্নই যদি হয় ফাঁস, পড়ব কেনো বারো মাস? তাই প্রশ্নফাঁস বন্ধে আপনি যথাযথ ব্যবস্থা নিন। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, পরিচালনা পরিষদ, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, মনোবিদ ও সাংবাদিকদের নিয়ে বসুন। সর্বস্তরের মানুষের মতামত নিন। হয়ত একটা সঠিক সমাধান বেরিয়ে আসতেও পারে।

এখনকার পরিস্থিতি দেখে আমার ছোট মগজ যা ভাবছে, কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলার প্রয়োজন পড়ে না। সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে শিক্ষিত হয়ে দেশের কোনো সেক্টরে সফলতা তো আসবেই না, বরং দেশের ভবিষ্যত তছনচ হবে, সেটা অবশ্যম্ভাবী।

বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। এদেশে আজ আর ক্ষুধায় কেউ মারা যায় না, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আজ বিদ্যুত পৌঁছে যাচ্ছে। ছয় লাখের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ আজ ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা বিজয় করেছে।

মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। সেই উন্নতি যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পাশ করা নাগরিকের হাতে পড়ে, ধস নামবে দেশে।

আপনি কি সেটা চান? 

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com