মেঘের ভেলায় ভাসিয়ে হ্যালো আমায় পৌঁছে দিল নেপালে

জীবনের শুরু থেকেই সংসারে শুধু অভাব অনটন দেখেছি তাই নিজের পৃথিবীটাও ছিল ছোটো। সবার চোখে দিনমজুরের ছেলে হিসাবেই পরিচিতি ছিল আমার। কখনও নিজেকে সমাজের আর দশটা সচ্ছল লোকের সাথে মেলাইনি আর তাদের চোখেও তাচ্ছিল্য দেখেছি। আমার মনে হতো, এদের খেদমত করবার জন্যই গরিবের জন্ম।  
মেঘের ভেলায় ভাসিয়ে হ্যালো আমায় পৌঁছে দিল নেপালে

কখনও কেউ আদর করে উৎসাহ দিয়ে বলেনি, ছোটো থেকেও বড় হওয়া যায়, দেখায়নি বড় মানুষ হবার স্বপ্ন। বরং অনেক বিত্তবান লোক আমার পরিবারকে বলেছে, লেখাপড়াসহ সব খরচ তারা দেবে, বিনিময়ে আমাকে তাদের কাজ করে দিতে হবে।

আমার এই পনেরো বছরের জীবনে কত কাজেই না হাত দিয়েছি! শপিং ব্যাগ তৈরি, মেলায় মেলায় আচারের দোকান, লটারি বিক্রি, নার্সারিতে কাজসহ আরও কত কী!

তখন মনে হতো, বড় হয়ে বড় জোর পোশাক শ্রমিক বা অন্যের দোকানের দোকানদার হতে হবে।

এর পরের গল্প রূপকথাকেও হার মানায়।

ভালবেসেই ফেইসবুকে লেখালেখির শুরু। সেখান থেকে পেলাম হ্যালোর হদিশ। শুরু হলো শিশু সাংবাদিক হিসেবে হাতেখড়ি। হ্যালো আমারসহ অনেক শিশুর স্বপ্ন পূরণের কারিগর। হ্যালো আমাকে পৌঁছে দিয়েছে সুদূর আকাশের সীমানায়। কারণ টাঙ্গাইলের অজ পাড়া থেকে হ্যালোই আমাকে পৌঁছে দিয়েছে আর এক নতুন দেশে।

দেশটির নাম নেপাল। তার আগে আমার গ্রাম থেকে টাঙ্গাইল শহরে আসারই সুযোগ হয়নি কখনও। আর সেখান থেকে ইউনিসেফের এক শিশু সম্মেলনে নেপালে যাবার সুযোগ আমার বড় মাপের মানুষ হওয়ার ক্ষুধাকে দ্বিগুণ করে দিয়েছে।

হ্যালোতে মাত্র নয় মাস লেখালেখির সুবাদে এই বিদেশ যাত্রার ব্যাপারটি নিয়ে আমি খুব খুশি হলেও, আত্মীয়-স্বজন, মা-বাবা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। তারা ভাবলেন, শিশু পাচারের মতো কোনো ঘটনা নয়তো?

তবে হ্যালোর ভাইয়া, আপুদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে যখন পাসপোর্ট করা হয়ে গেলো, সব ভয় কেটে গেলো। প্রথমবারের মতো চলে এলাম রাজধানী শহর ঢাকায়!

ঢাকা এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম অফিসে পৌঁছানো, পুরোটাই ঘুমের বাইরের স্বপ্নের মত লাগছিল।

ঢাকায় জায়গা হয়েছিল পরিচিত এক মামার হোস্টেলে। পরদিন অফিসের গাড়ি এসে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে ভাবতেই মনে হলো, অনেক বড় মানুষ হয়ে গেছি আমি!

পথে প্রথমে সহযাত্রী পৃথা প্রণোদনা, পরে হ্যালোর নির্বাহী সম্পাদক প্লেটো দাদাকে তুলে নিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্টে। দুজনের নির্মল ও অমায়িক সুন্দর ব্যবহারে আমার একবারও মনে হয়নি আমি অপরিচিত কোন লোকের সাথে কোথাও যাচ্ছি।

চেক ইন করার সময়, আমার অজ্ঞতার কারণে পারফ্যুমের বোতলটা জব্দ করে নিলো। মা বারন করেছিলেন ওটা কিনতে।

জীবনের প্রথম আকাশে উড়ছি মেঘের ভেলায় ভেসে। নিজেকে রূপকথার রাজপুত্র মনে হয়েছে। চারপাশে মেঘ আর মেঘ দেখতে পেয়েছি। মেঘ গুলোকে নিজের পায়ের তলার মাটি। হিমালয় পাহাড়ের ওপর দিয়ে মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে ঘণ্টাখানেক বাদেই পৌঁছে গেলাম নেপাল।

নেপাল এয়ারপোর্টে নেমেই দেখতে পেলাম আকাশের মেঘ ছুঁয়ে চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় পাহাড়।এয়ারপোর্টর ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিলল নানা বর্ণের, নানা ভাষার মানুষ। প্রথমবার এত দেশের মানুষ এক সাথে দেখতে পেলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বের সোজা হোটেল।

নেপালের রাস্তায় যানজট আছে তবে কম। ধূলাবালি শুধু আমাদের দেশে নয় নেপালেও আছে তবে ওখানে কোন বখাটের দল দেখিনি। মেয়েরা তাদের পছন্দসই পোশাকে স্বাধীনভাবে চলছে।

আমি র‍্যাডিসন হোটেলে রুম পেলাম ছয় তলায়। পৃথা দ্বিতীয় তলায় আর প্লেটো দাদা একতলায়। এত বড় রুমে একা এই প্রথমবার।আসলে আমার সব অভিজ্ঞতাই প্রথমবার। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। পর দিন সকাল সকালে ইউনিসেফ-র কনফারেন্স।

সারাদিন বিভিন্ন দেশের প্রজেক্ট দেখলাম এবং মন্তব্য করলাম। এভাবেই কেটে গেল দিন।সন্ধ্যায় জম্পেশ পার্টি হলো। বন্ধুতা হলো।ভারতীয় বন্ধু কিশোর ও আকরামের সাথে আমিও নাচলাম।

সেদিনের মত এত আনন্দ কোনো দিন পেয়েছি কিনা সন্দেহ আছে।

মিটিংয়ে ভারতের আকরাম ও অঞ্জলি আর নেপালের সীতা ও সেজান এবং ভুটানের দর্জি আর জিম্মি, এদের ভুলব না।   

পরদিন চারটা গ্রুপে ভাগ হয়ে গেলাম মাঠ প্রজেক্টে।

সেখানে একটি স্কুলে মাদকাসক্ত শিশুদের সংশোধন, শিক্ষা, বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। তারাও চায়, শহরের স্কুলের মত তাদেরও থাকুক চিত্রকলা বিভাগ, কম্পিউটার ল্যাব, লাইব্রেরি।

আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে, ঐ স্কুলের এক ছাত্রী আমার অটোগ্রাফ নিলো। জীবনের প্রথম অটোগ্রাফ দেওয়া, এক অন্যরকম অনুভূতি।

অবশেষে আমাদের ছুটি। বের হলাম শপিং করতে। মা, বোনের জন্য পাসমিনা চাদর, নিজের জন্য নেপালি টুপি, শিক্ষকদের জন্য চাবির রিং আর বন্ধুদের জন্য চকলেট কিনলাম।

আমাদের তিন জনের মধ্যে পৃথা সবচেয়ে বেশি শপিং করেছিল। ওর শপিং দেখে ইউনিসেফ-র লোকও অবাক।

রাতেই প্যাকিং করে সকালে দেশের ফেরবার জন্য রওয়ানা হলাম। আবার বিমানে চেপে মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com