ধীরে ধীরে অন্যদলের বন্ধুরাও আসতে লাগল সেখানে। আমরা মেতে উঠলাম আনন্দে, জল খেলায়। একজন আরেকজনকে জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল। সাগরের জলে দৌড়াতে দারুণ লাগে। আমি দৌড়েছি। কোন কারণ ছাড়াই। হয়তো আনন্দে। আমাদের লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি, দুষ্টামি- সবকিছুর সাক্ষী হয়ে আছে অনেকগুলো ক্যামেরা। আর প্রিন্স স্যারের ফটোগ্রাফি তো আছেই!
দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবারের মেনুতে ছিল ফ্লাইং ফিশ। এটা একটা সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছ। খানিকটা সময় জিরিয়ে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার দ্বীপটা ঘুরে দেখার পালা। একটা সাইকেল ৪০ টাকায় এক ঘণ্টা ভাড়া পাওয়া যায়। বিষয়টা মন্দ লাগেনি আমাদের। আমরা কয়েকজন এই সুযোগটা লুফে নিই। তারপর বালুর মধ্যে অনেক কষ্টে সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে সৈকতটা ঘুরে দেখি। দ্বীপের ভেতরের অনেকটা অংশও দেখে ফেলি সেই এক ঘণ্টার মধ্যেই। এর ফাঁকে চলতে থাকে বিভিন্ন মাছের ফ্রাই খাওয়া। যে কেউ ভাবতে বাধ্য আমরা ওখানে শুধু মাছই খেতে গিয়েছি।
আর সেন্ট মার্টিনের ডাব মিস করা মানে বিশাল বড় একটা মিস! আমি ওখানকার ডাবের জলের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। লবণাক্ত পানির ছড়াছড়িতে সেখানে একজন ট্যুরিস্টের শরীরকে হাইড্রেটেড রাখার জন্য ডাবের জল সব থেকে ভাল বিকল্প বলে আমি মনে করি। বড্ড রহস্যময় স্রষ্টার তৈরি এই পৃথিবী। একটা পথ বন্ধ থাকলে আরেকটা পথ খোলা পাওয়া খুব কষ্টের কিছু না।
গড়িয়ে এল সেদিনের সন্ধ্যা। চাঁদ আলো দিচ্ছে। পরদিনই ছিল পূর্ণিমা। আমরা ফুলমুন দেখব কক্সবাজারে গিয়ে। কারণ দ্বিতীয় দিন দুপুরের মধ্যে ছেঁড়া দ্বীপ ঘুরে এসে বিকেলেই রওয়ানা হব কক্সবাজারের দিকে। এমনটাই লেখা ছিল শিডিউলে।
সন্ধ্যায় সাগরের গর্জন দারুণ লাগে। খুব ইচ্ছে করছিল ডায়েরিটা নিয়ে বসি। নিজের সাথে একটুখানি আলাপ করি। কিন্তু সেই সুযোগ হয়ে ওঠেনি । বন্ধুদের সাথে কাটিয়েছি সময়। খুব মজা করেছি। সেদিন রাতে আমাদের জন্য বার-বি-কিউ পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। বন্ধু ইনানের নাচ ছিল সেই সন্ধ্যায় দারুণ মজার। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত ‘গানের কলি’ খেলেছি। গান গেয়েছি গলা খুলে আর আড্ডা দিয়েছি। শুধু আমরা নই টিচাররাও আমাদের সাথে গলা মিলিয়েছেন।
‘ভাল আছি ভাল থেকো’ গানটার রিমিক্স ভার্সনের জন্য আমাদের প্রিন্স স্যারের জুড়ি নাই। সেই আসরে স্যার গেয়েছিলেন গানটা আবারও, মাতিয়ে তুলেছিলেন আসর। ব্রাদার তরেনের গানের কণ্ঠের প্রশংসা না করলেই নয়। ব্রাদারের কণ্ঠে ‘ও রে নীল দরিয়া’ গানটি সেই মুহূর্তের সাথে খুব গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল। জ্যোৎস্না ছাওয়া সাগরের ঢেউয়ের মৃদু কলকল আওয়াজ, সাগর-তীরে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ আর ব্রাদারের কণ্ঠের সেই গান- আমাদের সবার ভেতরে এক অন্য রকমের অনুভব দিয়েছিল।
পলাশ স্যারকে আমরা বাঘের মতো ভয় করে চলি কলেজে। খুব কড়া শাসনের মধ্যে রাখেন উনি আমাদেরকে। কিন্তু সেই আসরে তার উপস্থিতি আমাদেরকে কতটা অবাক করেছিল, সত্যিই বলে বোঝানো যাবে না।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই সূর্যোদয় দেখি। সাগরবেলায় সূর্যোদয়ে মুগ্ধ হতেই হয়। পরে ডাবের জল খেতে খেতে ফিরে আসি কটেজে। গোসল করে তৈরি হয়ে নিই ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার জন্য।
এবারের যাত্রা ট্রলারে করে। আমাদের ট্রলারে পেয়েছিলাম অসীম স্যারকে। ছেঁড়া দ্বীপ যাবার সময়টুকু ছিল অন্যরকম সুন্দর। বিশাল সাগর আর অসীম আকাশের মাঝে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগছিল। ‘লাইফ অব পাই’ মুভিটার কথাও মনে পড়ছিল বারবার।
দ্বীপে প্রবালের দেখা পেয়েছি। আর পুরো দ্বীপ জুড়েই শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক শেওলা। সবচেয়ে সুন্দর জীবন্ত সবুজ প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল একটা একলা হিজল গাছ। ওটার নিচে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুলেছি।
অনেক শামুক আর ঝিনুক কুড়িয়েছি। ঘোরাঘুরি শেষে আবার ফিরে গিয়েছি ট্রলারের কাছে। ।
দ্বিতীয় দিন আবার নাফ নদীর তীরে। সেখান থেকে বাসে করে সোজা কক্সবাজারে। পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। তারপরেও সেই রাতেই আমরা ঘুরে দেখি সৈকত। পূর্ণিমার আলোয় দেখা সমুদ্র সত্যিই অসাধারণ লেগেছিল। ঢেউয়ের গর্জন আমার কাছে খুব ভয়ঙ্কর লেগেছে। সেন্ট মার্টিনের সৈকতের ঢেউ এমন লাগেনি।
পরের দিন হিমছড়ি, ইনানির বীচ দেখতে যাওয়া। হিমছড়ি ছিল একদম স্বপ্নের মতো। মনে হচ্ছিল আকাশ আর সমুদ্রর একদম মাঝামাঝি কোথাও দাঁড়িয়ে আছি।
এরপর ইনানি বীচ। বন্ধু ইনান আবার সেই বীচে একটা ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করার সময় ক্যাপশন দিয়েছে- ‘ইনানীর মাঝে ইনান’। হাহাহা।
সে রাতেই আমরা ট্যুর শেষ করে ঢাকায় ফিরলাম। ফেলে এলাম অনেকটুকু সময়। কুড়িয়ে এনেছি তারও চেয়ে বেশি।