অনেক ওপরে উড়ছে গাঙচিল। ডানামেলা গাঙচিল। কী অসাধারণ! নাফ নদীর হালকা স্রোত আর গাঙচিলের মিষ্টি ডাক দারুণভাবে মিশে গিয়েছিল আমাদের আড্ডার সাথে। হঠাৎ ব্রাদার তরেনের নির্দেশে আড্ডার তাল গেল কেটে, সবাই উঠে পড়লাম জাহাজে। তবে জাহাজ ঘাটে হ্যাট আর চিপসের প্যাকেট কিনে নিতে ভুললাম না কেউই।
হ্যাট, প্রচণ্ড রোদ থেকে খানিক রেহাই পাবার জন্য। চিপস, জলে ছুঁড়ে দিয়ে দূরের গাঙচিলকে কাছে আনার জন্য। আইডিয়াটা দিয়েছিলেন ব্রাদার তরেন। কলেজে সবসময় ডিসিপ্লিনের কড়া নিয়মগুলো যার মুখ থেকে সবচেয়ে বেশি শুনে আমরা অভ্যস্ত সেই মানুষটা এতো সহজ, সুন্দর, শৌখিন ও রসিক, এই ট্যুরের বদৌলতেই জানতে পারলাম।
এছাড়াও আমরা সত্যিই খুব ভাগ্যবান ছিলাম, কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ব্রাদার শুভ্রত আমাদের সাথে ছিলেন। ছিলেন কলেজের আরও ১৪ জন শিক্ষক।
জাহাজে চড়া আমার জীবনে এই প্রথম। আমাদের প্রিন্স স্যার শুধু একজন ভাল গণিতের শিক্ষকই নন, একজন ভাল ফটোগ্রাফারও। জাহাজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে থেকে আমিও আর সবার মতো গাঙচিলকে কাছে ডাকতে ব্যস্ত, তখনই স্যার তুলে নিয়েছেন অসাধারণ একটি ছবি। সেই ছবিটি আপাতত আমি ব্যবহার করছি আমার ল্যাপটপের ওয়ালপেপার হিসেবে।
স্যারের নেতৃত্বে কলেজ টিমের হয়ে একবার লাখনাউ গিয়েছিলাম একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য। সেখানেও স্যার অসাধারণ কিছু ছবি তুলেছিলেন আমার। চমৎকার ফটোগ্রাফির জন্য অনেক বার ধন্যবাদ জানিয়েছি স্যারকে। এই লেখার মধ্য দিয়ে আরও একবার তার প্রতি প্রকাশ করছি কৃতজ্ঞতা।
আমাদের বাংলা বিভাগের শিক্ষক নির্মল স্যার আমাদের যাত্রার আনন্দকে করে তুলেছিলেন আরও বেশি কাব্যময়। তবে হ্যাঁ, টাইটানিক মুভির অনেকগুলো রোমাঞ্চকর মুহূর্ত বারবার উঁকি দিচ্ছিল আমার ভেতরের আয়নায়, যদিও নদী-সাগরের সেই সংগমস্থলে নিজেকে পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা করে নিয়ে সেই আয়নায় শুধুমাত্র নিজের প্রতিচ্ছবিই খুঁজতে থাকা সবচেয়ে বড় প্রশংসার দাবি রাখে।
খানিকক্ষণ বাদেই সাগরের জল দেখা, নীলে ভাসা- সবই অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এসে পড়বে। কী হবে তখন? অদ্ভুত এক অনুভূতির শিহরণ অনুভব করলাম। জাহাজের প্রায় অর্ধেক যাত্রীই আমরা। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই যার যার মতো প্ল্যান করতে করতে দুর্জয়ের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলাম- ‘তোমারও অসীমে, প্রাণ-মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই, কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদও নাই’।
শেষতক পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশের সবথেকে বড় প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের খুব কাছাকাছি। ব্যাগপত্র গুছিয়ে সবাই নামার প্রস্তুতি নিলাম।
দ্বীপে নামা মাত্রই আমার মনে হচ্ছিল একটা ভিন্ন দেশে এসে নামলাম। কিন্তু পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি নেটওয়ার্ক পুরোপুরিই আছে। তার মানে এটা আমারই দেশ। কিন্তু এই দ্বীপটা পুরোই আলাদা।
শিক্ষকদের জন্য আলাদা হোটেলের ব্যবস্থা ছিল। আর আমাদেরকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল অন্য কটেজ। পথে যেতে দেখলাম অনেক শুঁটকির দোকান, সামুদ্রিক মাছের দোকান, ছোট ছোট রেস্তোরাঁ। সেগুলোয় পছন্দ মতো তাজা মাছ ফ্রাই করে দেওয়া হচ্ছিল। দেখেই আমার জিভে জল এসে গেলো। রাস্তার পাশের সারি সারি সবুজ টাটকা ডাবের দৃশ্য ছিল এক কথায় হেভেনলি!
তাড়াতাড়ি কটেজে গিয়ে চেঞ্জ করে মুখ ধুতে গিয়েই আঁতকে উঠলাম। পানি এতো লবণাক্ত! ইস! কটেজের বাইরের টিউবওয়েলের পানিও তাই। কী আর করা! শুধু মনে বাজতে লাগল একটা কথা- পৃথিবীতে অভ্যাস বলতে কিছু নেই, পরিবর্তনের নামই বেঁচে থাকা। অবশ্য এটাও মাথায় এসেছিল- এই দ্বীপে থাকাটাতো কিছুক্ষণের জন্য। তবে সারা জীবনের জন্য হলে কী খুব মন্দ হতো?