বিশ্বাস করি, মানুষের জন্য মানুষ

বিকেল বেলা। শীত তেমন না থাকলেও আলসেমি করে বেলা গড়িয়ে গোসল করতে গেছি। আমি স্নান করি পুকুরে।
বিশ্বাস করি, মানুষের জন্য মানুষ

পুকুরে নামতে যাব তখনই মনে হলো পাড়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। এভাবে অনেকক্ষণ বসে থেকে ঝুপ করে লাফ দিলাম পুকুরে।

শীত শীত ভাব থাকায় গোসল সারলাম কোনো মতে। পুকুর থেকে উঠছি এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে আমার বোনের চিৎকার ভেসে আসে।  কিছু না বুঝেই বাড়ির দিকে সোজা হাঁটা শুরু করি।

কী হয়েছে বোন? জিজ্ঞেস করি কৌতুহল নিয়ে। বোনের দুর্বল উত্তর- তেমন কিছু না, তাড়াতাড়ি ঘরে এস। ঘরে ঢোকার আগে, বারান্দা থেকে চাপা সুরে মার কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। ভয় বাড়ে আমার। সবার কান্না দেখে অশ্রু জমাট বাঁধে চোখের কোণে। কী হয়েছে মা?  কোনো উত্তর নেই। আবার জিজ্ঞেস করি একি কথা। কাঁদতে কাঁদতে মা বলে, “একটি মেয়ে ফোন করে বলল,  তোর বাবা নাকি গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছেন! উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে বলেছে।”

একটা তুফান বয়ে গেল আমার উপর দিয়ে। মা’র কথা শুনে আমি থ। বলার ভাষা নেই মুখে। বড় ভাইয়া ঢাকায়। ঘরে আমি, মা আর বোন ছাড়া আর নেই। পুরো ঘর জুড়ে কান্না ছাড়া কোনো শব্দ নেই। চারদিকে কেমন খা খা করছে। একটা বিষণ্ন ভাব ছড়িয়ে আছে বাড়িতে।

বাড়ি থেকে বানিয়াচং উপজেলা হাসপাতাল খানিকটা দূরে। এদিকে মেয়েটার বারবার ফোন, “জলদি আসুন।”

আমার পা চলে না, গাড়ি চলে না যেন। সব থমকে আছে। অ্যাকসিডেন্ট গুরুতর নাকি হালকা জানার উপায় নেই।  হাসপাতালে যেয়ে দেখি, রক্তে ভিজে গেছে বাবার জামা। সম্ভবত মিনিট পাঁচেক আগে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছেন তিনি। চেয়ে আছেন অপলক দৃষ্টিতে। আমার চোখ শুকিয়ে গেছে। কান্না আসছে না। যেন গ্রীষ্মের মরুভূমি। অধিক শোকে এক ফোঁটা জলও বেরুচ্ছে না চোখ দিয়ে।

অবস্থা খারাপ দেখে হবিগঞ্জ একটি প্রাইভেট হাসপাতাল নিয়ে যাই বাবাকে। সঙ্গে বড় মামা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, শরীরের কোথাও হাড় ভাঙেনি। নাক-মুখ এবং মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে প্রচুর।

তখনও আমি ঘটনার আগা-গোড়া কিছু জানি না। বাড়ি ফিরে বাবার মুখে শুনে নিলাম সব।

সিএনজি করে যাচ্ছিলেন। সামনে থেকে হঠাৎ একটা জীপ গাড়ি ভুল পথে এসে সজোরে ধাক্কা মারে। গতি সামলাতে না পেরে রাস্তা থেকে ছিটকে খালের নিচের গিয়ে পড়ে সিএনজি। গাড়িতে একজন মহিলা এবং একটা ছোট ছেলে ছিল। মহিলাটার অবস্থা বাবার মতো। আশে-পাশে যে দু-চারটা ঘর ছিল ওখানকার মহিলারা কলসি করে পানি এনে বাবার মাথায় ঢালে। অবস্থা বেগতিক দেখে একটা মেয়ে বাবাকে হাসপাতাল নিয়ে যায়। সেই ফোন করে আমাদের জানায় অ্যাকসিডেন্টের কথা।

বাবা বলেন, “মেয়েটা না থাকলে আমার যে কী হতো;  কল্পনাতীত।”

এমনিতেই বাবার প্রেসার হাই। দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে শরীর। জানি না মেয়েটাকে। দেখিনি কোনোদিন। পরের দিন বিকেলে মেয়েটাই ফোন করে বাবার খোঁজ নেন। জগতে এরকম ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবী টিকে আছে। ফোনে আম্মার সাথে পরিচয় হয় তার। পরে জানতে পারলাম, তার নাম শারমিন সুলতানা। একটি এনজিওতে কাজ করছেন অনেক দিন ধরে। বাড়ি ঢাকায়।

প্রিয় বোন! আপনার এই ঋণ শোধ করতে পারব না আমরা কোনো দিন। শুধু শুভ কামনা রইল- আপনার মঙ্গল হোক।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com