যৌন ও প্রজনন শিক্ষার শুরু হোক বাড়িতেই

রাখঢাক, গোপন কথা, নিষিদ্ধ শব্দ হিসেবে যৌন ও প্রজনন বিষয়টির সঙ্গে আমরা খুব গোপনে পরিচিত হই। এ যেন নিজের সাথে নিজের গোপনীয়তা। তাই ঘর থেকেই শুরু হওয়া উচিত এই শিক্ষা।
যৌন ও প্রজনন শিক্ষার শুরু হোক বাড়িতেই

উন্নত বিশ্ব এসব নিয়ে রাখঢাক না করলেও এই ইস্যুটি ট্যাবু হিসেবেই রয়ে গেছে বাংলাদেশের শিশু, পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজে। এই গোপনীয়তা কোনো শুভবার্তা বয়ে আনে না বা শিশুর এতে কোনো উপকার হয় না। বরং তাদের পড়তে হয় নানান সংকটে। পার হতে হয় অসহায় মুহূর্ত। কাউকে হাঁটতে হয় বিকৃত রাস্তায়।

খোলা গায়ে থাকার সময় শিশুরা নিজেদের যৌনাঙ্গে হাত দেয়। অন্য শিশুর সঙ্গেও তারা এমন করে। এসময় বড়রা ধমকে দেন তাদের। কিন্তু মনোবিজ্ঞান পড়ে জানলাম, শিশুকে ধমক না দিয়ে তাকে সঙ্গত কারণ দর্শান উচিত।

এক্ষেত্রে বকাঝকা করলে শিশু কিছু শিখতে পারবে না বরং শরীর সম্পর্কে তার বিরূপ ধারণা তৈরি হবে। শিশুকে বোঝানো উচিত, শরীর একটি ব্যক্তিগত জিনিস। আর কিছু কিছু অঙ্গ একদম ব্যক্তিগত। সেখানে হাত দেওয়া লজ্জার বা অন্যায় নয়। বরং অন্যের সামনে এটা করা অশোভন।

শেখান যেতে পারে, তোমার ব্যক্তিগত স্থান স্পর্শ করার অধিকার কারোরই নেই । কেউ যদি সেটা করে তাহলে অবশ্যই বাবা-মা, শিক্ষক, ভাই-বোন বা যার সাথে সম্পর্ক সহজ, তাকে বলতে হবে।

সম্প্রতি মীরপুরের একজন মা তার পাঁচ বছর বয়সী কন্যা সন্তানকে গান শেখানোর জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ দেন। কম বয়সী শিক্ষকের বদলে একজন প্রৌঢ় লোককে নিরাপদ মনে করেন। আর সেই ব্যক্তি শিশুটির সাথে শারীরিকভাবে অশোভন আচরণ করেন।

স্পর্শের পার্থক্য, ভালো-খারাপ স্পর্শ আর পিডুফিলিয়ানদের (মানসিক রোগী-যারা শিশুকামী হয়) সম্পর্কে শিশুকে ধারণা দেওয়া উচিত। ভয় দেখিয়ে নয়, শিশুর সঙ্গে বন্ধুর মতো ভরসা দেওয়া অভিভাবকের কর্তব্য।

আমাদের সমাজের চিত্র অনেকটাই উল্টা। এখানে অনেক অভিভাবক শিশুদের বুঝতেই চেষ্টা করেন না। শিশুর মতের বিরুদ্ধে যেমন মত চাপিয়ে দেন তেমনি শিশুর শরীর সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হওয়াকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। কারণ অনেক বাবামারও এসব জ্ঞান বা তথ্য জানা নাই।

অনেক সময় তার শৈশবেও তাকে এসব শেখানো হয়নি। সিলেবাসেও এসব বিষয় ছিল না। প্যারেন্টিং কী তা না জেনেই তারা পিতামাতা হয়ে যান। কিছু সংস্কার ও কুসংস্কার সন্তানদের সাথে সহজ হতে বাধা দেয় তাদের।

অথচ সন্তানের সব রকম কৌতূহলের জবাব দিতে পারা সবার আগে বাবামার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। অদ্রীশ বর্ধন নামের একজন লেখকের একটি বই পেয়েছিলাম, ‘আমার মা সব জানে’। সেখানে শিশুর সব কৌতূহলের জবাব দিচ্ছেন, মা।

প্রত্যেক বাবামা সম্পর্কেই যদি আমরা এই কথা বলতে পারতাম তবে অনেক সংকট কমে যেত।  এমন কি শ্রেণি ও বয়স অনুপাতে প্রত্যেক শ্রেণিতেই যদি একটি বিষয় থাকত, যে বই থেকে শিশু তার মনের কৌতূহল মেটাতে পারত কী ভালই না হতো!

শিশুরা প্রায়শই উদ্ভট সব প্রশ্ন করে থাকে। কারণ চারপাশের সবকিছুই তার কাছে নতুন। নিজের অজান্তেই অভিভাবককে অপ্রস্ততুত করে দেয় অনেক সময়। এক্ষেত্রে খুব কম সংখ্যক অভিভাবক শিশুদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেন বা পরে উত্তর দেবেন বলে নিজেকে তৈরি করেন। তার বদলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানকে ধমক বা মারধরের শিকার হতে হয়। এর ফলে শিশু নিজেকে গুটিয়ে ফেলে নিজের মধ্যে। বন্ধুহীন হয়ে নিজের অনুসন্ধিৎসাকে মাটিচাপা দেয়।

‘আমি কোথা থেকে এলাম?’-শিশুর এই প্রশ্নে বাবামা তাকে বলেন- তুমি আকাশ থেকে এসেছো, বা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পেয়েছি তোমাকে।  এরকম আগড়মবাগড়ম ব্যাখ্যা না দিয়ে বয়স অনুপাতে যদি তাকে জন্মরহস্যটা বোঝানো যায়, উভয়েই উপকৃত হবে।

বেশিরভাগ অভিভাবকরা তা বোঝেনই না। বরং বয়ঃসন্ধির মত স্পর্শকাতর সময়টাতেও শিশুর পাশে কীভাবে দাঁড়াবেন নিজেরাই জানেন না। কিন্তু তারা সারাক্ষণ নজরদারি করেন, তার সন্তান লুকিয়ে সিগারেট খেলো কি না, প্রেম করে কি না, ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছে, মোবাইলে কি দেখছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফল দাঁড়ায় গালমন্দ বা মারধর। আর এভাবেই অভিভাবকের সাথে দূরত্ব বাড়ে সন্তানের। ভালোবাসা ও ভক্তির জায়গা দখল করে ভয় ও বিরক্তি। কখনও ঘৃণা! এমন কি স্কুলেও শিক্ষক যখন শরীর চর্চার বই পড়ান তখন সংকোচে এড়িয়ে যান বয়ঃসন্ধি, প্রজনন স্বাস্থ্য, শিশুজন্ম বিষয়ক অধ্যায়গুলো। প্রশ্ন করার অবকাশ তো দূরের কথা। তার আগেই বলে দেন এই অধ্যায়গুলো বাসায় পড়ে নিতে। এমনকি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এসব বিষয় বিশদে থাকলেও তা পড়ানো হয় না। 

কানাকানি, অস্পষ্টতা কিংবা খানিকটা ইঙ্গিত শুধু নয়, বাবামায়ের উচিত গল্প, ঘটনা, তথ্য, ছবি দিয়ে সন্তানকে বোঝানো। ঘনিষ্ঠজনরাও এর দায় এড়াতে পারেন না।

উন্নত দেশে স্কুল এবং কলেজে যৌনশিক্ষা বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পাঠদান করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের মার্চে স্কুলগুলোতে ব্রিটিশ সরকার ১১ বছর বয়সীদেরও শিশুদের যৌন সম্মতি সম্পর্কিত শিক্ষা দিতে হবে বলে নির্দেশ দেয়।

শুধু তাই নয় পর্নোগ্রাফি, সেক্সটিং, কনসেন্ট সেক্স এই তিন বিষয় পাঠ্যপুস্তকে নিয়ে আসার প্রস্তাব পেশ করেছে ব্রিটেন। পাঠশালায় সেক্স এডুকেশন এবং রিলেশনশিপকেও আবশ্যিক করার জন্য প্রস্তাব পেশ করেছে এই সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রও এগুলোকে ট্যাবু মনে করে বসে নেই। আর জার্মানিতে যৌন শব্দটি স্বাস্থ্যের সাথে কতটা জড়িত, তা শেখানো হয় প্রাথমিক স্কুলেই৷

কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ গোঁড়ামি ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এখান থেকে পরিত্রাণের উপায় অভিভাবকের শিক্ষা ও সচেতনতা। আর বয়স অনুপাতে সিলেবাসে আবশ্যিক পাঠ্য হিসাবে এই ইস্যুটি যোগ করা। প্রচার মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানও এর সমাধান আনতে ভূমিকা রাখতে পারে। 

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com