শিশুআইন লঙ্ঘনে বিপন্ন শিশু

আইনের তোয়াক্কা না করে হামেশাই শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ যেন ডালভাত হয়ে উঠেছে।
শিশুআইন লঙ্ঘনে বিপন্ন শিশু

শিশুদের সুরক্ষায় ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার। যেখানে শিশু অপরাধী সম্পর্কে বলা হয়েছে, নয় বছরের কম বয়সী শিশুকে কোনো অপরাধের অভিযোগে আটক করা বা শাস্তি দেওয়া যাবে না৷ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কাউকে আটক করা হলে তাদের হাতকড়া বা কোমরে দড়ি লাগানো যাবে না৷ এছাড়া শিশুকে ‘আসামি’ না বলে বলতে হবে অপরাধের সংস্পর্শে আসা শিশু।  

সেই আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের বিচার হতে হবে শিশু-কিশোর আদালতে৷বিচার শেষে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে৷ সেখানে থাকার সময় নির্ধারিত হবে আদালতের নির্দেশনা অনুসারে।

এছাড়াও আরো বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আইনটিতে। কিন্তু প্রতিনিয়তই শিশু আইন পদদলিত হচ্ছে।

জুনে পাশ হওয়া আইনটি কার্যকর হয় একই বছরের ২১ অগাস্ট থেকে। ঠিক এদিনই রাজধানীর চামেলীবাগে আলোচিত পুলিশ দম্পতি খুনের ইস্যুতে তাদের মেয়ের বয়স যাচাই করতে ডাক্তারের কাছে নিতে চায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। যদিও আইনে বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন কিংবা প্রাসঙ্গিক দলিল  উদঘাটনের কথা বলা হয়েছে। মেয়েটির এসব নথিসহ পাসপোর্ট থাকা সত্বেও এবং এত স্পষ্ট নির্দেশনার পরও শিশু আইন কার্যকরের দিনই তার উল্টো ঘটনা ঘটে।

এর আগেও বেআইনিভাবে বয়স বাড়িয়ে পুলিশ দম্পতির মেয়ে এবং তাদের শিশু গৃহপরিচারিকাকে রিমান্ডে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে।

এরপর ২০১৫ সালে ঘটে যাওয়া আরেকটি খবর দৃষ্টিগোচর হয় অনেকের। ১২ অগাস্ট কাফরুল থানায় পৃথক দুটি মাদক মামলায় দুই শিশুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরদিন হাজির করা হলে আদালত একজনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় আর অন্যজনকে একদিনের রিমান্ড মন্জুর করে। পরে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর এই দুই শিশুকে ৬ সেপ্টেম্বর বেআইনিভাবে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকার আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। জন্মসনদ অনুযায়ী একজনের বয়স তখন সাড়ে ১৬ বছর হলেও পুলিশ মামলার এজাহারে তার বয়স দেখায় ১৯ বছর। এজাহারে অন্য জনের বয়স ১৫ বছর দেখানো হলেও তার প্রকৃত বয়স ১২ বছর বলে জানান তার আইনজীবী। ঘটনাটি জানাজানি হলে নিন্দা প্রকাশ করেন বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

এর মাস দুয়েক পর ৭ নভেম্বর এক চুরির মামলায় ১২ বছরের শিশুকে খিলগাঁও থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তা জানাজানি হয়। মামলার নথিতে দেখা যায়, আদালত থেকে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় আইন লঙ্ঘন করে শিশুটিকে ‘আসামি’ বলা হয়েছে।

শুধু এই ঘটনাগুলোই নয় একই বছর হবিগঞ্জ থেকে আসে আরেকটি খবর। স্কুলছাত্রীকে মারধরের ঘটনায় ১৪ বছরের এক শিশুর সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ৷ তাকে হাতকড়াও পরানো হয়৷

২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর এক খুনের মামলায় দুই শিশুকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। মামলার এজাহারে শিশু দুটির বয়স বলা হয় ১২ বছর। কিন্তু অভিভাবকরা জানান, তাদের বয়স নয় বছরের কম। দুই শিশুকে গ্রেপ্তার এবং জবানবন্দি রেকর্ড করে শিশুআইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদটি প্রকাশিত হলে দুই শিশুকে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন দেয় সর্বোচ্চ আদালত। বয়স নির্ধারণ না করে শিশু দুটিকে গ্রেপ্তার ‘শিশু আইনের’ লঙ্ঘন উল্লেখ করে নিরাপত্তা দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

শিশুআইন লঙ্ঘনের ঘটনাক্রম চলতে চলতে ২০১৭ সালে এসেও থামেনি। শিশুর প্রতি নির্মম দৃষ্টিভঙ্গির চিত্র আবারো সামনে আসে। রাজনৈতিক মামলায় সাড়ে তিন বছর ধরে এক শিশুর কারাগারে থাকার সংবাদ প্রকাশিত হয়। আদালত সূত্র নিশ্চিত করে, এ মামলায় একজন পরিণত বয়সী আসামির সঙ্গে তার বিচার চলছিল। ছেলেটি হিন্দু হলেও মামলার এজাহারে তাকে মুসলমান হিসেবে দেখানোর অভিযোগও ওঠে।

একের পর এক শিশু আইন লঙ্ঘন একটি রাষ্ট্রের জন্য বড় অশুভ বার্তা। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের সাথে এমন আচরণ অগ্রগতিতে যে প্রভাব ফেলবে তা সহজেই অনুমেয়। এখানেই শেষ নয়। শিশুদের রাখার জন্য আইনে যে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে তার অবস্থা অনেকেরই অন্তরালে।

গাজীপুরে দু'টি এবং যশোরে একটি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে৷ এরমধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ কেন্দ্রগুলোর স্ব স্ব তথ্যমতে সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ছয়শ জনের মতো৷

তবে পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা অপরাধে আটক করা হচ্ছে৷ এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে হিসাব পরিচালনা করেছে শিশু অধিকার ফোরাম নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যেখানে ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই দুশো ৭৬ জন শিশুকে আটকের কথা ওঠে আসে৷

এ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা হয় তিন দশক ধরে নারী ও শিশুর অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে আসা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সঙ্গে।

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী হ্যালোকে বলেন, ‘শিশু আইনের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য অনেক সময় শিশুদের বয়স (১৮ বছরের বেশি) বাড়িয়ে দেয় পুলিশ। ভিক্টিমের পক্ষে চ্যালেঞ্জ করার লিগ্যাল সাপোর্টও সাধারণত থাকে না। তখন বেআইনিভাবে শিশুটিকে সাধারণ আইনের আওতায় আনা হয় এবং সংশোধনাগারে না পাঠিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।’

সংশোধনাগারের অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটখাট একটা অপরাধ করে সেখানে গিয়ে আরো বড় ধরণের অপরাধ শিখছে শিশুরা। কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সবকিছু নেই। নিয়মিত মনিটরিং পদ্ধতি চালু করা দরকার। আগাম খবর দিয়ে তবে কারা পরিদর্শনের ব্যবস্থা হয়। এভাবে তো ভেতরে কী হচ্ছে সেই পরিবেশ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ জানতে পারবে না। কেন্দ্রগুলো অতর্কিতে পরিদর্শন করা দরকার।’

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাজীপুরের টঙ্গীতে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে নির্যাতন এবং ঠিকমত খাবার না দেওয়ার প্রতিবাদে ২০ জন শিশু ধারালো ব্লেড দিয়ে তাদের হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ জখম করে। পরে সমাজসেবা অধিদপ্তর তদন্ত করে ঐ শিশু-কিশোরদেরই দায়ী করে৷ এমনকি তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের ‘বেয়াড়া' মন্তব্য করা হয়৷

এর তিন মাস পর যশোরের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রেও প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে৷ মারপিট, নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ সাতটি অভিযোগে কিশোররা বিদ্রোহ করলে পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করতে গুলি ছোঁড়ে৷ পুলিশি ধাওয়া ও গুলিতে আহত হয় ১৩ কিশোর৷ পরে নির্যাতনের মুখে ১৬ জন শিশু-কিশোর পালিয়ে যায়৷ এসব কেন্দ্রে বেআইনি ভাবে নয় বছরের কম বয়সী শিশুদের রাখা হয় বলে ঘটনার পর তদন্তে বেরিয়ে আসে।

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যে সবার আগে গুরুত্বারোপ প্রয়োজন জানিয়ে এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট নঈমা আক্তার বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্য খুবই সেনসেটিভ। এটা বাহ্যিক নয় বলে আমরা অন্যের অবস্থাটা সহসা বুঝতে পারি না। আর শিশুদের ক্ষেত্রে তো একটু বেশিই যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।’

খবরে অপরাধের সংস্পর্শে আসা শিশুর পরিচয় প্রকাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিশুরা অপরাধ করে না, তারা ভুল করে। বয়স কম হওয়ায় তাদের সংশোধনের সুযোগও থাকে। কিন্তু ভুল আইনি পদ্ধতি বা গণমাধ্যম তাদের অপরাধী বলে প্রচার করলে তখন শিশুটি সবার চোখে অপরাধী হয়েই থাকে। আর শিশুটির ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে এটাই যথেষ্ট।’

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com