গুহাচিত্র ও বিবর্তনের ইতিহাস

নৃতাত্বিকদের মতে গুহাচিত্র কেবলই চিত্র না থেকে আমাদের জানায় আদিম সমাজের জীবনের গল্প। মানুষের বিবর্তন, সংগ্রাম আর টিকে থাকার ইতিহাস। যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবীর বিকশমান এই অধ্যায়।

প্রাচীন চিত্রশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন গুহাচিত্র। প্রাচীন তো বলছি, কিন্তু তা কত প্রাচীন? বলছি সেই সময়ের কথা যখন মানুষ বাস করত গুহায়, খাদ্যের জন্য নির্ভর করত পশু শিকারের উপর। তখন মানুষ যে শুধু শিকার করে, বনে জঙ্গলে ঘুরেই জীবন কাটাত তা নয়। তারা তাদের তৎকালীন ধ্যান-ধারণা, জীবন যাপনের ছবি এঁকে রাখত গুহার দেয়ালে। এসব চিত্রই গুহাচিত্র বা কেভ পেইন্টিং নামে আমাদের  কাছে পরিচিত। এ পর্যন্ত সভ্য মানুষের আবিষ্কার করা গুহাচিত্রগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার মারকো দ্বীপের গুহাচিত্রকেই সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়, যার আনুমানিক বয়স প্রায় ৩৫,০০০ বছর।

এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গুহাচিত্রগুলোর মূল বিষয়বস্তু শিকার, বিভিন্ন জীব-জন্তু এবং সেসময়ের মানুষের জীবন ব্যবস্থা। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের প্রধান শিকার ছিল বাইসন ও হরিণ। এই প্রাণীগুলো শিকারের চিত্রই দেখা যায় বেশিরভাগ ছবিতে। কোনো ছবিতে আছে অস্ত্র-বিদ্ধ পশু, কোনো ছবিতে আছে আহত পশু, কোনোটিতে আবার আছে পশুর পাল। মানুষকে নিয়ে আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে আছে ঘোড়াসওয়ারের ছবি, নৃত্য, বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের ছবি ইত্যাদি। ধারণা করা হয় শিকারের ছবিগুলো আঁকা হতো শিকারের পশুকে আয়ত্বে আনার জন্য। তখনকার মানুষের মাঝে বাস্তব ও অলৌকিকতার ভেদ হয়তো ছিল না। তারা ভাবত পশু শিকারের ছবি আঁকলে ছবির সম্মোহনী ক্ষমতায় শিকার সহজ হবে। অর্থাৎ, তাদের কল্পনায় জয় করার যে ইচ্ছা সেটাই ফুটে উঠত শিকারের এই ছবিগুলোতে। এছাড়া অন্যান্য বিষয়বস্তুর ছবিগুলো ধর্মীয় বা সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার জন্য আঁকা বলেই ধারণা করা হয়।

গুহাচিত্র আঁকতে সে সময়ের শিল্পীরা প্রাকৃতিক উপাদানই ব্যবহার করত। রঙ হিসেবে রঙিন মাটি, কয়লা ও বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য ব্যবহার করা হয়েছে। গুহার দেয়াল সমান করার জন্য পাথর দিয়ে ঘষা হয়েছে। অন্ধকার গুহায় আলোর জন্য পাথরের প্রদীপ জ্বালানো হতো যার জ্বালানি ছিল পশুর চর্বি।

সারা পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য গুহাচিত্র। শুধু ফ্রান্স আর স্পেনেই প্রায় ৩৪০টি গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া গিয়েছে স্যান জাতির মানুষের আঁকা গুহাচিত্র। এগুলোর আনুমানিক বয়স ৩,০০০ বছর।  এতে আছে মানুষ ও পশুর ছবি। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই এগুলো আঁকা হয়েছে বলে মনে করা হয়। ২০০২ সালে ফরাসী প্রত্নতাত্বিক দল সোমালিয়ায় ৫,০০০ বছরের একটি গুহাচিত্রের সন্ধান পায় যেখানে বন্যপশু ও সাজসজ্জা করা গরুর ছবি দেখা যায়। ২০০৮ সালে উত্তর সোমালিয়ায় আরেকটি গুহাচিত্র আবিষ্কার করেন প্রত্নতাত্বিকরা। ধারণা করা হয় প্রাচীন ঘোড়াসওয়ারদের চিত্রগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ১৯৯৩ সালে আলজেরিয়ার একটি এলাকায় পাথরে খোদাই করা প্রায় ১৫,০০০টি চিত্র আবিষ্কৃত হয়। এই চিত্রগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সালের দিকের। এই চিত্রগুলোতে দলবদ্ধ পশুর অভিবাসন, জলবায়ুর পরিবর্তন, এবং মানব বসতির পরিবর্তন দেখা যায়। ভীমবেটকা প্রস্তরক্ষেত্র ভারতের মধ্য প্রদেশের প্রাচীন মানব বসতির নিদর্শন। এখানে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন চিত্রটি ৩০,০০০ হাজার বছর আগের। এই চিত্রগুলোতে আছে মানব শিশু জন্ম নেওয়া, নৃত্য,ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মৃতদেহ সৎকারের দৃশ্য। এছাড়া দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার কাউন্টি, সান্তা বারবারা, ভেন্টুরায় চুমাস উপজাতিদের আঁকা গুহাচিত্র, ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব এলাকার ন্যাশনাল পার্কে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং বার্মায় অসংখ্য গুহাচিত্র রয়েছে।

গুহাচিত্রগুলো শুধুই প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন নয়। এসব চিত্রের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক কালের মানুষের জীবন যাপনের পদ্ধতি জানা যায়, বোঝা যায় মানব সভ্যতার পরিবর্তন, সেই যুগের জীবজন্তুদের সম্পর্কে ধারণা নিয়ে প্রাণীর বিবর্তনের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com