বিপ্লবী ক্ষুদিরাম (প্রথম পর্ব)

উপমহাদেশে ব্রিটিশদের শাসন, শোষণ  ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে।

আজ আমরা স্বাধীন জীবন যাপন করছি। এর পেছনে যত বীরের অবদান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু।

জীবনের জয়গান গেয়ে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া এই বীরের জন্ম ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের কাছাকাছি কেশপুর থানার মোহবনী মতান্তরে হাবিবপুর গ্রামের ত্রৈলক্যনাথ বসুর ছেলে।

ক্ষুদিরামের বয়স যখন সাত বছর তখন তার বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার ছয় মাস পরে মাও মারা যান। ফলে দুঃখ এবং একাকীত্ব হয়ে যায় তার নিত্যসঙ্গী। আশ্রয় হয় দূরসম্পর্কের এক দাদা ও বৌদির কাছে।

দাদা-বৌদির ঘরে তাকে অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। দিনের পর দিন নিষ্ঠুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। সেখান থেকে বোনের বাড়িতে ঠাই হয় তার।

পরবর্তিতে মেদেনীপুরে দিদি অপরূপা দেবীর সংসারেই বেড়ে ওঠেন। ক্ষুদিরাম গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর মেদিনীপুর ‘হ্যামিল্টন’ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন মেদিনীপুরের ‘কলেজিয়েট’ স্কুলে। মেধাবী হলেও পড়াশোনায় মন বসত না কিশোর ক্ষুদিরামের। সুযোগ পেলেই খেলাধুলা আর ব্যায়াম করতেন।

বন্ধুদের নিয়ে পাড়া দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি। ক্লাস ফাঁকি দেয়া, পড়াশোনা না করা বাউণ্ডুলে এই ছাত্রের প্রতি শিক্ষকদের তিরস্কার ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। ফলে ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর ক্ষুদিরামের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

স্কুল ছাড়লে কী হবে, স্কুলের অদূরে ভবানী মন্দির ছিল ক্ষুদিরামের প্রিয় জায়গা। সেই মন্দির প্রাঙ্গণ ছিল তার দুদণ্ড শান্তির আশ্রয়। সেখানেই একদিন এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে।

তৎকালীন সময়ে সত্যেন বসুই ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঙলাকে মুক্ত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। এই সত্যেন বসুর হাত ধরেই ক্ষুদিরামের বিপ্লবী জীবনের শুরু।

এতদিনের ডানপিটে, বাউণ্ডুলে, রোমাঞ্চপ্রিয় ক্ষুদিরাম যেন মনের মতো কাজ পেলেন। দেশের জন্য নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ক্ষুদিরামকে সত্যেন বসু সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন নামে বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত সংগঠনে যুক্ত করে দেন।

রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্রিটিশ বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত দলটিতে শিষ্য হিসাবে দীক্ষা গ্রহণ করেন ক্ষুদিরাম। এই দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে সত্যেন্দ্রনাথ একটি তাঁতশালা স্থাপন করেছিলেন। তাঁতশালার আড়ালে তিনি শিষ্যদের লাঠিখেলা, অসি চালনা, বোমা ফাটানো, পিস্তল, বন্দুক ছোড়া, নৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেরও শিক্ষা দিতে শুরু করেন।

এ সময়েই পিস্তল চালনাতে ক্ষুদিরামের হাতেখড়ি হয়। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ক্ষুদিরাম এই তাঁতশালার দক্ষ সদস্য হয়ে পড়েন এবং তার গুণাবলীর জন্য সবার চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তিনি শপথ গ্রহণ করেন দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশদের অন্যায় অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত করার মতো দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে।

এই ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করার আন্দোলনে বালক ক্ষুদিরাম কিন্তু নেমেই বড়দের মতোই ভীষণ সাহস দেখান। তখনই দিদির বাড়ির সঙ্গে চিরদিনের জন্য তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।

১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেদিনীপুরের মারাঠা কেল্লায় এক শিল্প প্রদর্শনী হয়। সেখানে সেই যুগের বিখ্যাত রাজদ্রোহমূলক পত্রিকা সোনার বাংলা বিলি করার দায়ে পুলিশ ক্ষুদিরামকে ধরতে গেলে তিনি পালিয়ে যান। কিন্তু পরে ধরা পড়েন। তার বয়স অল্প হওয়ায় পুলিশ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত আমদানিকৃত কাপড় পোড়ান ও লবণে বোঝাই নৌকা ডোবানোর কাজে  অংশগ্রহণ করেন তিনি।

সে সময় বিপ্লবীদের রাজদ্রোহ মামলায় কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড মরিয়া হয়ে ওঠেন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের প্রয়োজনভিত্তিক কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণার পাত্র ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূলে কাঁপন ধরাতে বিপ্লবীরা ১৯০৮ প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেন কিংসফোর্ডকে হত্যা করার।  

যথাসময় এ দায়িত্ব এসে পড়ে ক্ষুদিরাম বসুর ওপর। আর তার সহযোগী করা হয় রংপুরের আরেক যুবক বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকে।

১৯০৮ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষুদিরাম বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র কলকাতার গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়িতে বসেই তৈরি করলেন শক্তিশালী বোমা। এই বোমা বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত বলে এর নাম দেওয়া হয় 'বুক বোম'। (চলবে)

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com