প্রচারবিমুখ তাজউদ্দীন আহমদ

চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মুখে হাসি। সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতেন সহজেই। ইনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তার নাম তাজউদ্দীন আহমদ।

বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গেলে তাজউদ্দীন আহমদের নাম আসবে অবধারিতভাবেই। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত  স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন।

দশ ভাই-বোনের বড় পরিবারে তার বেড়ে উঠা। পড়াশুনা শুরু হয়েছিল বাবা মোহাম্মাদ ইয়াসিন খানের মক্তবে। ছাত্র হিসেবে ছিলেন বেশ মেধাবী। স্কুলজীবনে পরীক্ষায় প্রথম হতেন সব সময়। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বোর্ডে হয়েছিলেন দ্বাদশতম। ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে লাভ করেন চতুর্থ স্থান। 

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসার ২ বছর আগে ১৯৪২ সালে হয়েছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তাজউদ্দীনের    বয়স তখন ১৭। তরুণ তাজউদ্দীন তখন বেসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। 
তরুণ বয়সেই রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়ান। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর আরো সক্রিয় হয়ে উঠেন রাজনীতিতে।

পাকিস্তান ছিলো দুই ভাগে বিভক্ত। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোতে তাজউদ্দীন ছিলেন বরাবর সক্রিয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন।

১৯৬৪ সালে কারাবন্দি অবস্থাতেই এলএলবি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেশ করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি। সেখানেও তিনি সাথে ছিলেন। সেই বছর আবার কারাবন্দি হন এবং মুক্তি পান ১৯৬৯ সালে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলায় পাঠ করেন শপথ। বৈদ্যনাথতলাকে নাম দেন মুজিবনগর। ঘোষণা করেন রাজধানী হিসেবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দিনরাত পরিশ্রম করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা পরিবার-পরিজন ছেড়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাজউদ্দীন সংকল্প করেন মুক্তিযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না তিনি।  

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব তুলে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হন তিনি।

১৯৫৯ সালে সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলিকে বিয়ে করেন তিনি। মানুষ হিসেবে তাজউদ্দীন ছিলেন খুব সাধারণ। স্ত্রীর কথা মতো তাকে বিয়ে করেছিলেন বেলী ফুলের মালা পরিয়ে। তার স্ত্রীও রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।

তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনায় ২০০৭ সালে তাজউদ্দীন আহমদ এক নিঃসঙ্গ সারথী নামের একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়। সেখানেই উঠে আসে এসব তথ্য। সেখানে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু কখনও তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস কিভাবে কাটিয়েছেন তা জানতে চাননি। এ কারণে তার মনে আক্ষেপ ছিল।   

মানুষ হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ  আদিখ্যেতা পছন্দ করতেন না। তথ্যচিত্রটিতে বলা হয় কোনো সভা শেষে ছবি তোলার সময় এলে ক্যামেরার সামনে থেকে সরে যেতেন তিনি।

ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানোর ইচ্ছে ছিল না তার। বলেছিলেন, “আসুন আমরা এমন ভাবে কাজ করি যে পরবর্তীতে ঐতিহাসিকরা যখন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবেন তখন যেন আমাকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।”   

১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুরে জন্ম নেন তিনি। মারা যান ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। 

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com