কিশোরীর  নিরাপত্তা দিন দিন কমেছে

কয়েক যুগ ধরে কিশোরীদের নিরাপত্তা কমতে কমতে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন কয়েক জন নারী। তাদের কিশোরীবেলার অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে পরিস্থিতির অদলবদল। 

৫৫ বছর বয়সী গৃহিনী মাহমুদা আক্তার বড় হয়েছেন কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে।

তিনি বললেন,  “আমাদের কৈশোরে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনকার মতো এতো টেনশন ছিল না।

“মেয়েদেরকে উত্যক্ত করার কোন অভিযোগ পেলে ছেলের অভিভাবকদের নিয়ে সামাজিকভাবে বিচার হতো। মেয়েদের জন্য সমাজ মোটামুটি নিরাপদ পরিবেশ ছিল। ভয় পেতে হতো না। ”

তার অভিজ্ঞতায় দিনে দিনে পরিবেশ ভয়াবহভাবে পাল্টে গেছে। বর্তমানে মেয়েকে রাস্তাঘাটে ছাড়তে, এমন কি বাসায় রেখে বাইরে যেতেও ভয় হয় তার।

কিশোরবেলার স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, “এখন ছোটরা বড়দেরকে সম্মান করে না। বড়রাও অন্য কারোর ছেলেকে শাসন করতে ভয় পান। কিছু বললে বখাটেরা বড়দেরকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।”

মাহমুদার চাইতে আট বছরের ছোট নাজমা ইয়াসমীন। নাজমা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করেন।

 “আমাদের ছোটবেলায় মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে মা-বাবাকে এখনকার মতো এত দুঃশ্চিন্তা করতে হতো না। আমরা মহল্লা থেকে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। মহল্লায় ও স্কুলে ছেলেমেয়েরা একসাথেই খেলাধুলা করতাম। কোন ধরনের ইভটিজিং-এর কথা মনে পড়ে না,” বলেন তিনি।   

কোন মেয়েকে আজেবাজে কথা বললে মুরব্বিরা সেই ছেলেকে শাসন করতেন। আর এখন শিশু থেকে মাঝ বয়সী নারীরাও ইভটিজিং-এর শিকার হচ্ছে।

নিজেরা ভয়হীনভাবে স্কুলে যেতে পারলেও নিজের মেয়েকে তিনি একা একা স্কুলে পাঠাতে পারেন না।

তিনি বলেন, “আমি ও আমার স্বামী দুজনই চাকরি করি। কখনও আমি, কখনও আমার স্বামী আমাদের মেয়েকে স্কুল বা কোচিং ক্লাস থেকে আনা নেওয়া করি।

“আমাদের শিক্ষকরা বাবা-মায়ের মতো যত্ন করতেন। অথচ এখন শিক্ষকদের কাছেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। অনেক শিক্ষকই মেয়েদেরকে যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। “

তার আতঙ্কের সীমা তুলে ধরতে গিয়ে জানান, বাসায় যখন তাদের মেয়ে একা থাকে তখনও অফিসে কাজের ফাঁকে বারবার ফোন করেন খবর নিতে।

এখনকার মেয়ে শিশুরা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নাজমার চেয়ে আট বছর কম ঢাকার নাজনীন সুলতানা রত্নার।

নাজনীন বড় হয়েছেন মফস্বল শহরে।  বাসা থেকে হেঁটেই স্কুলে যেতেন তিনি। যাওয়া আসার সময় রাস্তায় বখাটে ছেলেরা বিরক্ত করত।  পথে মোটরসাইকেল নিয়ে পিছু নিত।

তিনি বলেন, “স্কুল-কলেজ থেকে ফেরার সময় আম্মা রাস্তায় এসে পায়চারী করতেন। আব্বা-আম্মা সবসময় টেনশন করতেন আমার নিরাপত্তা নিয়ে।

“রাস্তাঘাটের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে আমিও দুশ্চিন্তা করতাম, আতঙ্কে থাকতাম।”

তারা দুই বোন গান শিখতেন শিল্পকলায়। সে সময়ের একটি ঘটনা জানালেন তিনি, “আম্মা আমাদেরকে শিল্পকলায় নিয়ে যেতেন। কিন্তু আসা যাওয়ার পথে ছেলেরা এত উত্যক্ত করত যে শেষ পর্যন্ত  শিল্পকলায় যাওয়া আমাদের বন্ধ করে দিতে হয়।”

বর্তমানের সঙ্গে তাদের সময়ের ফারাক তুলে ধরতে গিয়ে নিজের কন্যার কথা তোলেন।

বলেন, “আমাদের মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। তার নিরাপত্তা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করতে হয়। কখনও আমি, কখনও ওর বাবা ওকে স্কুলে আনানেয়া করি। অন্য কারো সাথে ওকে কখনই একা কোথাও যেতে দিতে ভরসা হয় না।

“আমরা মা-মেয়ে যখন রাস্তায় চলাফেরা করি তখনও টেনশনে থাকি। বখাটে ছেলেদের ইভটিজিং-এর মুখোমুখি হতে হয়।”

প্রতিবাদ করতেও ভয় পান উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জানি না এই অবস্থা থেকে কবে আমরা মুক্তি পাবো!” 

সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছেন দিলরুবা মমিন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।

নিজের নিরাপত্তাহীনতার কাহিনি বলতে গিয়ে বলেন, “আমরা মেয়েরা একা একা স্কুলে যেতে ভয় পেতাম। কেউ না কেউ আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। ছুটির পর আবার নিয়ে আসতেন।  

তার কিশোরবেলায় বখাটেদের ইভটিজিং নিয়মিত ব্যাপার ছিল।  ইভটিজিংকে তারা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে করতেন।

শুধু রাস্তাঘাটে নয় মেয়েদের ইমেইল বা ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তাতে আপত্তিকর ছবি, ভিডিও পোস্ট করেও অপমান করা হচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতির আভাস দিতে গিয়ে বলেন, “এখন চাকরি করছি। কিন্তু এখনও মা সকাল-বিকাল ফোন করে খবর নেন অফিসে পৌঁছেছি কিনা, নিরাপদে বাসায় ফিরেছি কিনা। ”

নিরাপত্তাহীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে দাবি করে মন্তব্য করেন- আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেষ পর্যন্ত মেয়েদের স্বাধীনতায়।   

অনেকেই মেয়েদেরকে বোরখা পরতে, ঘর থেকে বের না হতে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। মেয়েদেরকে পিছিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।

এখন নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেহেরুন্নিসা স্কুলে যায় ওর বাবা-মায়ের সাথে।  

মেহেরুন্নিসা বলে, “একা একা কখনোই বাবা-মা আমাকে স্কুলে বা বাইরে কোথাও পাঠান না। কারণ প্রতিদিন কোথাও না কোথাও শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় আর তাই ওরা উদ্বিগ্ন থাকেন।”   

বাসার নিচে একা নামতে ভয় পায় ও। ভাড়া করা স্কুলভ্যানেও নিরাপত্তা বোধ করে না।বাড়ির বাইরে কোথাও খেলাধুলা করার সুযোগ নেই বলে জানায় সে।  

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com