ওদের কারও বয়স ১২, কারও ১৪ আবার কারও কারও ১৫ বছর। পরিবারে আর্থিক অবস্থাও ভালো না এই মেয়েদের। ২৪জন মেয়ে ফুটবলারদের মধ্যে সাত জন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর মেয়ে রয়েছে এই দলে।
‘সকল বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে’ এই ধ্বনি নিয়ে ২০১৪ সালের জুন মাসে রাণীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ তাজুল ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রা শুরু করে এই মেয়ে ফুটবল দলটি। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফুটবল খেলে সুনাম অর্জন করেছে ওরা।
১২ বছর বয়সী বিথিকা কিসকু বলে, “প্রথম প্রথম যখন মাঠে খেলতে আসতাম তখন পাড়ার মানুষরা খুব খারাপ কথা বলত।
“মেয়েমানুষ হাফ-প্যান্ট পরে মাঠে খেলি, এরকম অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আমার বিয়ে হবে না বলেও কটূক্তি করেছে অনেকে।
“আমি বলেছি বিয়ে না হোক, তবুও ফুটবল খেলব।”
প্রায় একই রকম কথা জানিয়ে ১৪ বছর বয়সী সোহাগী কিসকু বলে, “প্রথম প্রথম পরিবার থেকে বাধা দিত। পরে তাজুল স্যার বাবা-মাকে বোঝানোর পর এখন বাবা-মাই প্রতিদিন মাঠে আমাকে খেলতে পাঠান।”
ও আরও বলে, “এখন আমরা ঢাকাসহ নানা জায়গায় গিয়ে ফুটবল খেলছি। আমাদের সবাই চেনে এখন। আগে যারা খারাপ কথা বলত তারা আর ঐসব কথা বলার সাহস পায় না।”
হান্না হেমব্রম নামের একজন শিশু বলে, “স্কুল ছুটির পরই বিকাল ৪টায় এসে মাঠে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ফুটবল খেলি।
“এরপর বাড়ি গিয়ে পড়তে বসি। পড়ায় আগের থেকে এখন মনও বেশি বসে।”
শুধু দেশে নয় বিদেশের মাঠেও খেলার স্বপ্ন দেখছে মিনি হেমরম, আদুরী, মুন্নী আকতারসহ অনেকেই।
মুন্নী আকতার বলে, “ফুটবল খেলে অর্থ উপার্জন করে আমি পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে চাই। পরিবারের সবাইকে ভালো রাখতে চাই।”
এই খেলার হাত ধরেই শ্রেণি বৈষম্য কেটে যাচ্ছে জানিয়ে মিনি হেমব্রম বলে, “আদিবাসী মেয়ে বলে অনেকেই আগে মিশত না আমার সাথে। কিন্তু এখন আমরা হিন্দু, মুসলমান সব ধর্মের মেয়েরাই একসাথে খেলি। ফুটবল খেলতে অন্য এলাকায়ও যাচ্ছি। ধর্মের আর কোন ভেদাভেদ নাই। সব ধর্মের মেয়েরাই মিলেমিশে ফুটবল খেলছি।”
মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জয়নুল ইসলাম ও সুগা মরমু।
সুগা মরমু জানান, এইসব মেয়েরা কয়েক বছরেই অনেক ভালো ফুটবল খেলছে। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ফুটবল খেলে জয়ীও হয়ে আসছে। মেয়েরা আগে শুধু ঘরমুখী ছিল এখন তারা বাইরে আসছে। তাদের দেখে নতুন মেয়েরাও উৎসাহিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আগামীতে এই মেয়েদের অনেকেই আরও ভালো করবে এবং জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদান রাখবে।”
রাঙ্গাটুঙ্গি মাঠে এক ফুটবল টুর্নামেন্টে মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেখে তখনই তাদের নিয়ে একটা দল গড়ার চিন্তা করেন তাজুল ইসলাম।
“এরপর দু একজন রাজি হলে তাদের দেখে অন্যরাও রাজি হন।”
তিনি আরও বলেন, “মেয়েরা অনেক ভালো খেলছে। ঢাকায় এফএ অনুর্ধ্ব-১৪তে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। ফেয়ার প্লে ট্রফি জিতেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে খেলছে।”
মেয়েদের পারিবারিক অবস্থা ভালো না জানিয়ে তিনি বলেন, “মেয়েদের পুষ্টির অভাব রয়েছে। টাকার অভাবে পুষ্টিকর খাবারও খেতে পারে না। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবাহসহ প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো করিয়ে থাকি। সরকার যদি এই মেয়ে ফুটবলারদের পাশে এগিয়ে আসতো তাহলে তারা আরো এগিয়ে যেত।”
এ বিষয়ে রাণীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মো. নাহিদ হাসান বলেন, “মেয়েরা ফুটবল খেলছে এটাই আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা খেলতে যাচ্ছে এবং সফল হচ্ছে।
“উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের আর্থিক ভাবে সহায়তা করা হয়। তারপরেও সমস্যা হলে তারা যদি আবেদন করে বিষয়টি দেখব।”