'নতুন আইনে বাড়তে পারে বাল্যবিয়ের হার'

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নিজের অনিচ্ছায় বিয়ে হয় বনরাণী চিন্তের। তার স্বামী বিস্টুরাম রায়ের বয়সও তখন মাত্র ১৬।

১১ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ায় তখন পরিবার-সংসার সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না তার। এখন তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের মা।

নিজের বাল্যবিয়ের গল্প হ্যালোকে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ মালঞ্চা গ্রামের বনরাণী চিন্ত।

তিনি বলেন, গ্রামে অনেক মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। এতে মেয়েদের অনেক সমস্যাও হয়।

"বিয়ের পর মানসিক ও শারিরীকভাবে খুবই চাপ পেয়েছি। অনেক সময় মনে হয়েছে মরে যাই। গোপনে কেঁদেছি। শুধু মার কাছে যেতে ইচ্ছে করত।"

তিনি আরও বলেন, "বাচ্চাদের খেলতে দেখলে খেলতে ইচ্ছে করত, আবার বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু সব পথ বন্ধ ছিল।"

শারীরিক জটিলতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "প্রথম সন্তান জন্মের সময় বেশ অসুস্থ হই।"

আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেই বাবা-মা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিল বলে জানান তিনি।

নিজের ছেলে ও মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে দিবেন কি না এমন এক প্রশ্নে বনরাণী বলেন, আমার বাবা-মা যে ভুল করেছেন তা আমি কখনও করব না।

কথা হয় একই গ্রামের বয়সরী বালা নামে এক অভিভাবকের সাথে। অল্প বয়সে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে জীবনে অনেক বড় ভুল করেছেন বলে মনে করেন তিনি।

বড় মেয়েকে ১৬ বছর ও ছোট মেয়েকে ১৫ বছর বয়সে বিয়ে দেন তিনি। বিয়ের কিছু দিন পর ছোট মেয়ে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বড় মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে নানা গঞ্জনার শিকার হয়ে এখন বাবার বাড়িতেই থাকেন বলে জানান বয়সরী।

বনরাণী চিন্ত ও বয়সরী বালার দুই মেয়ের মতো অনেক মেয়েই ১৮ বছরের আগে বাল্যবিয়ের শিকার হন। যদিও এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই প্রশাসনের কাছে।

সম্প্রতি ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনও ৬৬ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের পাঁচ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। ১০-১৯ বছর বয়সের দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়।

সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়।

এদিকে পীরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ মালঞ্চা গ্রামের ২০জন কলেজ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মাঠে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। বাল্যবিয়ের খবর পেলেই সেই শিক্ষার্থীরা ছুঁটে যায়।

এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক বকুল কুমার রায় বলেন, "২০১৩ সাল থেকে পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আমাদের হিসাব মতে অর্ধশতাধিক বাল্যবিয়ে হয়েছে।

"এরমধ্যে মাত্র দুইটা বাল্যবিয়ে আমরা বন্ধ করতে পারি। এছাড়াও গোপনে আরো অনেক বিয়ে হয়ে গেছে। বাকিগুলো প্রশাসনের গাফিলতির কারণে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।"

বাল্য বিয়ের শিকার সবাই অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রী বলে জানান তিনি।

নকুল কুমার নামে আরও এক স্বেচ্ছাসেবী জানান, অসচ্ছলতার অজুহাতে অনেক পরিবার মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে।

এদিকে বিয়ের জন্য আগের মতোই মেয়েদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়স হওয়ার শর্ত রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৬’করার প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তবে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে' আদালতের নির্দেশনা নিয়ে এবং বাবা-মায়ের সমর্থনে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে।

এ কারণে বাল্যবিয়ের হার আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে মনে করেন গুড নেইবারস বাংলাদেশ পীরগঞ্জ সিডিপির ব্যবস্থাপক যোশেফ টুটুল বিশ্বাস।

তিনি বলেন, "কোনো মতেই ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখা যাবে না। এই বিশেষ প্রেক্ষাপট থাকলে বাল্যবিয়ের হার কমবে না বরং বাড়বে।"

ভৈলাতৈড় উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শিরিন আখতার বলেন, "বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়েকেই বিয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখা যাবে না। কেননা ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ের যদি বিয়ে হয় তাহলে সেই মেয়ে পরবর্তীতে গর্ভধারণ করলে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে যায়।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সমাজের সব নাগরিকের সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করেন ঠাকুগাঁও-৩ আসনের এমপি ইয়াসিন আলী।

তিনি বলেন, "বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। যেখানে বাল্যবিয়ে সেখানেই প্রতিরোধ করে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে।"

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com