সব শিশুর আছে আলাদা ব্যক্তিত্ব

অটিস্টিক শিশু তামজিদ বিন ইসলাম জয়ের এখন বয়স ১৬। জন্ম থেকেই তাকে নিয়ে এক অজানা লড়াইয়ে নামেন তার মা হাসিবা হাসান জয়া। পরে তিনি একটি বেসরকারি সেবা সংস্থায় প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজও করছেন। তার সাথে প্রতিবন্ধী বা অন্যরকম শিশুদের বেড়ে ওঠা নিয়ে কথা হয় পৃথা প্রণোদনার।

হ্যালোঃ ছেলের নাম কেন জয় রাখলেন?

জয়াঃ ওকে ধারণ করেই আমি জেনেছি, কিছু শিশু আছে অন্যরকম, যাদের একটু বেশি সহযোগিতার প্রয়োজন। ভয়াবহ প্রথম ৫মাস কিন্তু তখন জার্মান মিজেলস/রুবেলা ইনফেকশন হাইলি আমার রক্তে যা আমার বাচ্চার জন্য খুবই ক্ষতিকর। তখনও আমাদের দেশে এর টিকা ছিল না। তাহলে হয়তো জয় আর অন্যরকম শিশু হতো না। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জয় হলো। যাকে বলে অপরিণত শিশু। আমার মা বললেন সব যুদ্ধ জয় করে ও বেঁচে আছে, পৃথিবীর আলো দেখছে, তাই ওর নাম জয়ই-থাকুক।

হ্যালোঃ কখন থেকে বুঝতে পারলে ও অন্যরকম শিশু?

জয়াঃ জয়ের সমস্যা বহুমুখী। ওর বয়স যখন ৪ মাস তখন বুঝতে পারলাম ও শব্দে চমকে ওঠে না, ডাক শুনে তাকায় না। ওর কানে শোনার সমস্যা ধরা পড়ে। ওর চোখেও সমস্যা, চোখে আলো বেশি লাগে। এছাড়াও ওর সমস্যা স্লো লার্নার। তাই একাডেমিক পড়াশোনায় ও অনেক পেছানো, এখন ওর বয়স ১৬। পড়ছে মাত্র ওয়ানে।

হ্যালোঃ জয়কে বড় করতে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে?

জয়াঃ দুবছর বয়সে জয় প্রচণ্ড চঞ্চল ও দুরন্ত হয়ে ওঠে। মা হিসেবে আমি তখন হতাশ ও অসহায়। কী করব, বাসায় অন্যদের সহযোগিতা, মা হিসেবে আমার অনভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে আমি পাগল প্রায়। জয় আমার কিছু বোঝে না, খায় না ঠিক মতো। ওর আচরণগুলো অন্য বাচ্চার মতো স্বাভাবিক নয়। আমার জানা নেই কার কাছে যাব, কোন পথে এগুবো। জয়কে বড় করতে আমি অনেক কিছুই শিখে নিয়েছি। ফলে এখন আমি জয়কে যেমন খুব সুন্দর করে বুঝি, আর দশটা শিশুকেও তেমনি বুঝি। এখন আর আমার মনে হয় না, অন্যরকম শিশুর মা আমি। মনে হয় জয়কে আমার মাঝে পেয়ে আমি অনেকগুলো স্বর্গের শিশু যেন পেয়েছি।

হ্যালোঃ ওর পড়াশোনার ক্ষেত্রে কি কি সমস্যা হয়েছে?

জয়াঃ জয়ের চিকিৎসকরা বলেছিল ওকে নরমাল স্কুলে ভর্তি করতে। কিন্তু একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। তারা জয়কে নিল না। আমি হাল ছাড়লাম না। জয়ের যেমন মা প্রয়োজন আমি নিজেকে তেমন করে তৈরি করতে থাকলাম। মা হিসেবে আমি ওকে সাহায্য করতাম। কোনো কিছু শেখাতাম না, বরং শেখার পরিবেশটা তৈরি করে দিতাম।

হ্যালোঃ ওর মেধার কথাও আমরা শুনতে চাই।

জয়াঃ জয় ওর নিজের মতো। ও কাগজ দিয়ে যেকোনো জিনিসই বানিয়ে ফেলতে পারে। একবার তো টিস্যুবক্স দিয়ে রেডিও বানিয়ে ফেলে। তা দেখে আমরা তো অবাক! ও যা দেখে, চাইলে তা সে কাগজ দিয়ে বানিয়ে ফেলতে পারে।

হ্যালোঃ জয় এখন কেমন আছে?

জয়াঃ অনেক ভালো। জয় বেড়ে উঠেছে শুধু হাতে পায়ে নয়, মনে-বুদ্ধিতে। এখন আমার জয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বড়, ঠিক যেন আমার বাবার মতো। আমার মন খারাপ দেখলেই সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিজে খাবার আগে মাকে খাইয়ে দিতে চায়। জয় আমার পৃথিবী। আমার জীবনের আলো।

হ্যালোঃ ওকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন?

জয়াঃ আর দশটা শিশুর মতোই জয় সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে, নিজে স্বাবলম্বী হবে এটা আমার স্বপ্ন।

হ্যালোঃ পেশাগত ক্ষেত্রেও আপনি জয়ের মতো শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন, আমাদের দেশে এ শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্দকতাগুলো কি কি?

জয়াঃ এ ধরণের শিশুদের সবদিক বিবেচনা ও সমন্বয় করে যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা যে সাহায্যকারী দল থাকা প্রয়োজন তা আমাদের এখানে নেই। প্রতিটি শিশুই আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এটা আমরা খুব কম মানুষই জানি।

হ্যালোঃ জয়ের মতো শিশুদের প্রতি আমাদের করণীয় কি?

জয়াঃ অভিভাবকদের উচিত তাদের শিশুদের বোঝানো যে এই অন্যরকম শিশুরাও তাদের বন্ধু হতে পারে। এদের প্রতি কখনও কটূক্তি করা কিংবা খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়। এদের প্রতি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আচরণও সহনশীল হতে হবে। একটা সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব থাকলেই এ ধরণের শিশুরা নিজের মতো  করে বেড়ে উঠতে পারবে। এ শিশুদের উৎসাহ দেওয়া, সহযোগিতা করা এবং বিশ্বাস করা আমাদের দায়িত্ব। মনে প্রাণে মানতে হবে সবাই আমরা বন্ধু।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com