‘ঘরে ঘরে তখন আগুন আর লাশ’

যুদ্ধের সময় ৩ এপ্রিল পাক বাহিনী প্রথম টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের জামুর্কী ইউনিয়নের গোড়ান, সাটিয়াচড়া গ্রামে অভিযান চালায়। সেই রাতে বিধবা হন তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী সালমা আক্তার। সেই মর্মান্তিক রাতের স্মৃতি নিয়ে হ্যালোর সঙ্গে কথা হয় তার।
‘ঘরে ঘরে তখন আগুন আর লাশ’

হ্যালোঃ কেমন আছেন?
সালমা আক্তারঃ আল্লায় রাখছে ভালো।

হ্যালোঃ আপনাদের গ্রামে কীভাবে পাক বাহিনী ঢুকল। শুরুটা কী রকম ছিল?
সালমা আক্তারঃ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক দিয়ে পাক বাহিনী যাচ্ছিল ময়মনসিংহের দিকে। আগে থেকেই সেখানে ইপিআর বাহিনী লুকিয়ে ছিল। তারা বোমা মেরে পাকবাহিনীর গাড়ি উড়িয়ে দেয়। পাক বাহিনীর ধারণা ছিল মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে নাটিয়াপাড়ায় কিন্তু মুক্তিরা ছিল সাটিয়াচড়া ব্রিজের নিচে।

এই খবর জানাজানি হলে পাক সেনারা আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই সাথে ঝড়ে আম যেমন পড়ে তেমন করে গুলি ঝরতে থাকে। সামনে যাকে পায় তাকেই গুলি করে মেরে ফেলে।

হ্যালোঃ কাদের সাহায্য নিয়ে তারা সারা গ্রামে আগুন দিল?
সালমা আক্তারঃ স্থানীয় রাজাকারদের সাহায্যে পাক বাহিনী সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, তখন এত টিনের ঘর ছিল না। ছন এবং পাটকাঠি দিয়ে তৈরি সব ঘরবাড়ি। ঘরে ঘরে পাট, ধান এবং খড় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

এই গ্রামে বড় ঘরটাই ছিল আমাগো। তারপর ঐ পাশে ফজল স্যারগো আর আলম ভাইগো বাড়ি। সব পুড়িয়ে দেয় পাকিরা।

আমার ঘরে পাট, স্বর্ণসহ তখনকার আমলের প্রায় এক লাখ টাকার জিনিস পুড়ে যায়।

এই গ্রামের চার জন চাকরিজীবী, কৃষক আর ছাত্রসহ অনেককে হত্যা করে সেদিন।

হ্যালোঃ আপনার স্বামীকে হত্যা করল কীভাবে?
সালমা আক্তারঃ আমরা ময়মনসিংহে ছিলাম। ওখানে আমার স্বামী নায়েব ছিল, খাজনা তুলত। সারা দেশে গণ্ডগোল। জেলা শহরে বিপদ হবে বলে ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা গ্রামে চইলা আইলাম।

তার তিন দিন পরেই গ্রামে পাক বাহিনী আসল। আমার ছেলে রিপন তখন কোলে ছিল। ওর বাপ ওরে নিয়া পলাইতে গেছিল। কিন্তু পাকিসেনাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে নাই। তারা খুঁইজা বাইর কইরা রিপনরে কোল থেকে টান দিয়া নিয়া ওর বাপরে গুলি করল।

হ্যালোঃ আপনি কীভাবে বেঁচে গেলেন?
সালমা আক্তারঃ আমি আমাগো বাড়ির সামনের গর্তে পলায়া আছিলাম। আমি আমার দেবরসহ আরো পোলাপাইন নিয়া।

সেদিন আমাদের বাড়িতে যে ছেলেটা লজিং থাকত ওরেও গুলি করে মেরে ফেলে। আমি গর্তে ছিলাম বলে বাঁইচ্যা গেছি।

হ্যালোঃ পাক বাহিনীর অভিযান শেষে গ্রামের অবস্থা কেমন হলো?
সালমা আক্তারঃ সারা গ্রামে শুধু ছাই উড়ে। গ্রামে তো একটা কুত্তাও ছিল না। গ্রামের অনেক মানুষ তাগো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেছিল। হেরা আবার ফিরা আইল। তাদের এমন নির্যাতন চলে মে মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত। পরে আমার বাপের বাড়ি থাইকা নতুন টিন আইনা বাড়ি করলাম। যুদ্ধ শেষ হইলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিয়া গেল। কিন্তু আইজ পর্যন্ত কিছুই পাইলাম না।

হ্যালোঃ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
সালমা আক্তারঃ বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা আছিল দেশ স্বাধীন করব, সোনার বাংলা গড়ব কিন্তু সোনার বাংলা করার আগেই তারে মাইরা ফালাইলো।
স্বাধীনের পরে টাঙ্গাইলে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু জামুর্কীর মানুষের সাথে দেহা করার জন্য নামছাল, তখন মেলা মানুষ তারে ঘিরা ধইরা এই এলাকার বড় মুক্তিযোদ্ধা গাজী লুৎফর চেয়ারম্যানসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা তারে বিশাল বড় কইরা জামুর্কীর নামকরা সন্দেশ বানায় দিছিল। ভালো মানুষ বেশি দিন থাকে না, শয়তানরা তারে মাইরা ফেলল। এই মানুষটা থাকলে আইজ দেশের চেহারা অন্য রকম হইত।

হ্যালোঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
সালমা আক্তারঃ তোমাকেও ধন্যবাদ।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com