‘আমার কাঁধে পতাকা ছিল’ (দ্বিতীয় পর্ব)

১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঐতিহাসিক সেইদিনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী, প্রত্যক্ষদর্শী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর নিকটতম ছাত্রকর্মী মহিব উল ইসলাম ইদু আন্দোলনের নানা স্মৃতি নিয়ে কথা বলেন হ্যালোর সঙ্গে। গল্প করেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পার হওয়া দিনগুলোর।
‘আমার কাঁধে পতাকা ছিল’ (দ্বিতীয় পর্ব)

হ্যালোঃ  এর পাঁচদিন পর অর্থাৎ ৭ মার্চ রেসেকোর্স ময়দানে কি আপনি ছিলেন ?

মহিব উল ইসলাম ইদুঃ আমি তখন রাজারবাগ ইউনিওনের সাংগঠনিক সম্পাদক। ৭ মার্চের ঐ মঞ্চ তৈরির জন্য একটা বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিযোগ করা হয়েছিল। সেন্ট্রাল কমিটি থেকে সম্ভবত ৩০ ও মহানগর থেকে ২০ জন সেই বাহিনীতে নেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর আওয়ামিলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মুস্তফা ভাই মহানগরের ২০ জনের মধ্যে তিন নম্বরে আমার নাম লিখেছিলেন। মঞ্চ তৈরি থেকে শুরু করে ৭ মার্চ সভার আগ পর্যন্ত কাজ করেছি সেখানে। সারাদিন রেসকোর্সে পড়ে থাকতাম। ৬ মার্চ সারা রাত ছিলাম। ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন আমরা মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখান থেকে ভাষণ শুনছিলাম।

হ্যালোঃ সেই মুহুর্তে আপনারা কি টের পেয়েছিলেন যে ২৫ তারিখ রাতে কিছু ঘটতে যাচ্ছে?

মহিব উল ইসলাম ইদুঃ না আমরা বুঝিনি। তবে একটা কানাঘুষা চলছিল যে আজকেই হামলাটা হয়ে যেতে পারে। জনসভার উপর দিয়ে একটা হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল। সম্ভবত পাকিস্তান আর্মিরা ছবি নিচ্ছিল। জনগণ একটু আতঙ্কিত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঐ জনসভায় সবাই একটা করে লাঠি হাতে নিয়েই এসেছিল। জনজোয়ারের উত্তাল ঢেউ তখন রেসকোর্সে বইতে থাকে। ভয়কে সেখানেও হার মানতে হয়েছিল।

হ্যালোঃ আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেই গল্পটা শুনতে চাই।

মহিব উল ইসলাম ইদুঃ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আমি একজন প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা। যেহেতু আমি রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামিলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম সেহেতু রাজারবাগ পুলিশ লাইন আমাদের অধীনে ছিল। ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাড়ায় মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছিলাম। কোদাল, শাবল, গাইতি ইত্যাদি নিয়েই শত্রু মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম। ছাত্রলীগ থেকে ঢাকায় পাঁচটা ঠিকানা ঠিক করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা বাঙালির উপর হামলা করলে আমরা যেন নিজেরা নিজেরা ঐ পাঁচ ঠিকানায় একত্রিত হই। তো আমার ৩৫৫/১ মালিবাগ গুলবাগের বাসাটা একটা ঠিকানা ছিল। সবার সাথে আমিও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। পাক সেনাদের হঁটাতে গুলি চালাই। চলতে থাকল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।

হ্যালোঃ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে কিছু বলুন। কিভাবে কি করতেন?

মহিব উল ইসলাম ইদুঃ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে আামাদেরটা ছিল একটু উচ্চতর ট্রেনিং। আমাদের বলা হতো ‘পলিটিক্যাল মটিভেটেড ফ্রিডম ফাইটার’। আর সে জন্যেই ইন্ডিয়ান সেনারা আমাদের ডাকতো ‘লিডার সাহেবান’ বলে। ডিএলএফ (মুজিব বাহিনী) থেকে আমরা ট্রেনিং নিতাম। এটা গড়ে তোলা হয়েছিল ভারতের বেরাদুন জেলার টান্ডুয়া, চাকরাতা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ডিএলএফের চারজন প্রধান ছিলেন। তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনি। প্রধান প্র্রশিক্ষক ছিলেন বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন ছাত্রনেতা হাসানুল হক ইনু ভাই। সকাল দুপুর ট্রেনিং হতো, সন্ধ্যায় আবার পলিটিক্যাল ক্লাস হতো। আমাদের শেখানো হতো কিভাবে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করব মুক্তিযুদ্ধে আসার জন্য। শুনতে পাচ্ছিলাম মায়ার টানে অনেক বাবা মা সন্তানকে আসতে দিচ্ছেন না। আমরা মানুষকে বোঝাতাম। আমি এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কলকাতা থেকে বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে যেতাম। যুবকদের ট্রেনিংয়ে নিয়ে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করতাম। সকালে যেতাম বিকেলে কলকাতায় ফিরতাম।

হ্যালোঃ তখন ভারতে যাতায়াত করতেন কিভাবে?

মহিব উল ইসলাম ইদুঃ ট্রেনে যাতায়াত করতাম। অনেকের সঙ্গে আমিও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম সহায়ক কমিটি থেকে একটা পাস পেয়েছিলাম। সেটা দিয়ে ভারত যাতায়াতের জন্য সরকারি বাস ও ট্রেন ফ্রি ছিল। (চলবে...)

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com