মাইন বিস্ফোরণে শেষঘুমে বন্ধু

‘বয়স তখন ১৬ বছর। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। বড় হব, চাকরি করব। কিন্তু তার আগে তো দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে স্বাধীন করতে হবে! যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। অতএব, কোনো দ্বিধা নাই। বেরিয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে,’ এমনটাই বললেন সুবোধ চন্দ্র রায়।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া থানার মধুপুর গ্রামে জন্ম সুবোধ চন্দ্র রায়ের। বাড়িতে বাবা-মা আর চার ভাই এক বোন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ৬নং সেক্টর রংপুর-দিনাজপুরের সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশারের নেতৃত্বে পঞ্চগড় জেলার ভজনপুরে যুদ্ধে অংশ নেন।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। এই সেক্টরের সরাসরি পরিধি ছিল প্রথমে পশ্চিমে পশ্চিম বাংলার দিনাজপুরের বালুর ঘাট ও পূর্ব দিকে আসামের মানিকের চর পর্যন্ত।

সুবোধ বলেন, পঞ্চগড় জেলার ভজনপুর এলাকায় আমরা যুদ্ধ করি। আমাদের সাথে সবসময় একটি বন্দুক, একটি বেলচা (মাটি কাটার যন্ত্র), থালা আর গ্লাস থাকতো।

রাতে একটি গর্ত করে তার মধ্যে দুই বা তিনজন একসাথে ঘুমাতাম। একদিন রাতে আমার এক বন্ধু গর্ত করছে, আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। খুঁড়তে গিয়ে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়ে বন্ধুটি আমার চোখের সামনেই মারা যায়। ঘুমাতে যাওয়া আর হলো না। আমার সহযোদ্ধা বন্ধু আমার চোখের সামনেই শেষঘুমে ঢলে পড়লেন। আমিও আহত হই। বন্ধুর মৃত্যু আর নিজের মৃত্যুকেও এত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার আতঙ্ক কোনদিন ভুলতে পারব না। আরও এমন অনেক স্মৃতি আছে যুদ্ধের। যুদ্ধের বিভীষিকা তাকে এখনও তাড়ায়। তবু সুবোধ চন্দ্র রায় সেই ভাগ্যবান যোদ্ধাদের একজন, স্বাধীনতার পরে যিনি জীবিত ফিরে এসেছেন।

যুদ্ধ শেষে আবার গ্রামে এসে পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে চিনিকলে জুনিয়র অফিসার হিসাবে ১৯৭৮ সালে চাকরিতে যোগ দেন।

এখন তিনি দুই পুত্র সন্তানের বাবা। বড় ছেলে নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছেন। ছোট ছেলে পিইসি পরীক্ষা দিচ্ছে, রুহিয়া কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে।

তিনি নিজেকে একজন সফল যোদ্ধা ও বাবা মনে করেন।    

সুবোধ জানান, সরকার তাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও রেশন না দিলে হয়তো যুদ্ধের পরে নিজেদেরকে এভাবে গড়ে তুলতে পারতেন না। সংসার চালানো, সন্তানদের মানুষ করার জন্য সরকারের সহযোগিতা না পেলে পথে বসে যেতে হতো। তাই সরকারের প্রতি তিনি  চিরকৃতজ্ঞ।

‘তবে অনেক যোদ্ধা এখনও দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছেন শুনতে পাই। দেশের প্রতি অবদানের কথা বিবেচনা করে তাদের সবাইকে খঁজে বের করে সম্মানের সাথে বাঁচার অধিকার পৌঁছে দেওয়া জরুরি,’ অনুরোধ সুবোধ চন্দ্র সরকারের।  

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com