'পাখি দেখতে প্রথম পাহাড়ে' (শেষ পর্ব)

পর পর দুইবার এভারেস্ট জয়ী প্রথম বাংলাদেশী এম এ মুহিত সম্প্রতি হ্যালোর মুখোমুখি হয়েছিলেন। পাহাড়ের রোমাঞ্চকর স্বাদ ভাগাভাগির পাশাপাশি নিজের স্বপ্ন নিয়ে কথা হয় হ্যালোর সঙ্গে।
'পাখি দেখতে প্রথম পাহাড়ে' (শেষ পর্ব)

হ্যালোঃ ব্যাগে কী নিয়েছিলেন?

এম এ মুহিতঃ বিশেষ যে কাপড়, যেটাকে সামিট স্যুট বলি ঐটা আমার গায়ে ছিল। ব্যাগে বাড়তি দুই-তিন জোড়া গ্লাভস ছিল ও দুই-তিন জোড়া মোজা ছিল। এছাড়া একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার, যার ওজন প্রায় ৫ কেজি। অতিরিক্ত সিলিন্ডারগুলো ছিল শেরপার কাছে। একটা থার্মোফ্লাস্ক ছিল গরম পানি রাখার জন্য। একটা জলের বোতল, চকলেট, হরলিক্স, খেঁজুর-টেজুর আর কি। আগুন জ্বালানোর জন্য ছোট ছোট গ্যাস সিলিন্ডার নিয়েছিলাম। আর যন্ত্রপাতি তো সব আমার গায়েই।

হ্যালোঃ চলুন বাকি গল্পে ফিরি। ক্যাম্প ওয়ান, টু, থ্রি পার করলেন, কঠিন বাধা তিনিটি (স্টেপ ওয়ান, স্টেপ টু, স্টেপ থ্রি) আপনার সামনে এরপরেই চূড়া। এবার বাকি গল্পটুকু।

এম এ মুহিতঃ আমি বলেছি যে ক্যাম্প থ্রি অর্থাৎ লাস্ট ক্যাম্প থেকে এভারেস্টের চূড়ায় যেতে ১০/১২ ঘন্টা লাগে। ২০ মে রাত ৯টায় ক্যাম্প থ্রি থেকে চূড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পর্বতারোহীদের হেডলাইটের আলোতে মনে হচ্ছিল এভারেস্টের গায়ে কতগুলো জোনাকি পোকা লেগে আছে। ফার্স্ট স্টেপ রাত ১২টায় পার হলাম। তখন কয়েকটি মৃত দেহ দেখতে পাই। এমনিতেই গায়ে শক্তি ছিল না। লাশগুলো দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি সাতটি মৃত দেহ দেখেছি। সেকেন্ড স্টেপ অতিক্রম করি রাত ৩টায়। ওইখানেও মৃতদেহ দেখলাম।

যখন আমি থার্ড স্টেপের কাছে পৌছাই তখন ঘড়িতে সময় ভোর চারটা-সাড়ে চারটা। তখনই হঠাৎ একটু জোরে বাতাস বইতে লাগলো। আমি চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। মনে অজানা ভয় ধরে গেল। কিন্তু আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়িনি। মনে মনে ভাবলাম গতবার ফিরে গেছি, এবার জয় করবই।

সকাল পাঁচটায় শেষ বাধা অর্থাৎ থার্ড স্টেপে পৌঁছাই। তখনই হেল্প হেল্প বলে একটা চিৎকার শুনি। তখন আমার চোখের সামনে আয়ারল্যান্ডের একজন পর্বতারোহী মারা যান।

হ্যালোঃ সঙ্গে ওষুধ থাকে না? কেউ মারা গেলে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়?

এম এ মুহিতঃ পর্বতের উচ্চতায় কোনো ঔষধ কাজ করে না। কেউ যদি অসুস্থ হয়, একটিই ঔষধ তাকে নিচে নেমে আসতে হবে। যত নিচে নেমে আসবে তত অক্সিজেন পাবে আর স্বাভাবিক হতে থাকবে।

পর্বতের আট হাজার মিটার থেকে মৃত্যুপুরী শুরু হয়। ওইখানে চলে গেলে কেউ যদি মারা যায় তাহলে লাশ আনা হয় না। একজন উঠাই তো জীবন বাজি রাখা, আবার একটা ডেড বডি নিয়ে কে নামবে? একজন মারা যাওয়া ভালো নাকি তিনজন? নিশ্চয় একজন। তাই লাশ আনা হয় না।

হ্যালোঃ শেষ কঠিন বাধা অর্থাৎ থার্ড স্টেপ পার হলেন সকাল পাঁচটার দিকে। তারপর ?

এম এ মুহিতঃ থার্ড স্টেপ পার হয়েই চূড়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ২১ মে সকাল ৭টায় আমি চূড়ার শীর্ষে পৌঁছে যাই।

হ্যালোঃ চূড়ায় উঠার পর অনুভূতি কেমন ছিল। আর কি করলেন ওখানে, কতক্ষণ অবস্থান করে ফিরলেন?

এম এ মুহিতঃ উঠেই শেরপাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলি আমি। আধা ঘন্টা অবস্থান করেছি উপরে। প্রথম দশ মিনিট অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছিল। বাকি বিশ মিনিট অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই থাকি। অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া এটুকু থাকার সক্ষমতা আছে আমার। আমার দেহকে আমি এভাবেই তৈরি করেছি। আর আমি তো হাঁটাহাঁটি করিনি, বসেছিলাম। গরম পানি খাই, চকলেট খাই। খেজুরগুলো ঠাণ্ডায় শক্ত হয়েছিল, সেগুলো গরম পানিতে চুবিয়ে খাই তখন। তারপর স্পন্সরের লোগো নিয়ে ছবি তুলি, আমাদের জাতীয় পতাকা নিয়ে ছবি তুলি। এভারেস্টের চূড়াটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বাইশ-তেইশ ফুট লম্বা, এবং পাশে আড়াই থেকে তিন ফুট চওড়া।

যখন আবেগটা নিয়ন্ত্রণ করলাম তখন মনে হচ্ছিল, আই এম দ্য কিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে। আমি মৃত্যুর সাথে লড়াই করে টিকে আছি।

আরো মনে হচ্ছিল একলাফে যদি বাংলাদেশে চলে আসতে পারতাম। মনে পড়ছিল আমার স্বপ্নদ্রষ্টা ইনাম আল হকের কথা। উনার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। আমার জন্মদাতা বাবা-মা, ভাই বোনের প্রতিও কৃতজ্ঞ। আবহাওয়াটা সেদিন খুব ভালো ছিল। চারপাশ দেখলাম। সাড়ে সাতটা থেকে নামা শুরু করলাম।

হ্যালোঃ উঠা বেশি সহজ নাকি, নামা?

এম এ মুহিতঃ চূড়ায় চড়ার জন্য মানুষ সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে দেয়। চূড়ায় যখন উঠে পড়ে তখন তার সমস্ত উত্তেজনা শেষ হয়ে যায়। তখন কোনো শক্তিই থাকে না। কেউ যখন চূড়ার কাছে চলে যায় তখন ভাবে এই তো আমি উঠে যাব। কাছেই তো চলে এসেছি, নিচে নামবো না উপরেই যাব। তখন তিনি বুঝতে পারেন না তার শরীর কতটা দুর্বল হয়ে গেছে। তখন একটি উত্তেজনা কাজ করে উপরে উঠার জন্য সেটাই সামিট ফোবিয়া। তিনি চূড়ায় উঠে পড়ার পর সমস্ত উত্তেজনা হারিয়ে ফেলেন এবং নামার সময় তার সমস্ত দুর্বলতা ধরা পড়ে। তখন এতই করুণ অবস্থা হয় যে, তার আর শক্তি থাকে না তারপর মারা যান। আমাদের সাথে পাঁচজন মারা গেছেন।

হ্যালোঃ আপনি চূড়ান্তভাবে কবে নিচে নেমে আসলেন?

এম এ মুহিতঃ ২৫ মে একেবারে কাঠমান্ডু চলে আসি। ২৭ তারিখ বাংলাদেশ থেকে অনেকে আসে কাঠমান্ডু। বিকেল বেলা বাংলাদেশ দূতাবাস সংবর্ধনা দেয় আমাকে। ২৮ মে দেশে ফিরি।

হ্যালোঃ দেশে ফেরার পর কি দেখলেন? অনুভূতি কি?

এম এ মুহিত: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে যখন বিমান এসে নামল দেখলাম শত শত মানুষ অপেক্ষা করছে। ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলাম। আনন্দে তখন চোখ বেয়ে জল পড়ছে। আমি মৃত্যুঞ্জয়ী! আমি আমার দেশের মাটিতে পা রেখেছি। সে ভালো লাগা তো ভাষায় সংকুলান হবে না।

হ্যালোঃ এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পরিবার তো নিশ্চয় সায় দেননি। কীভাবে এ জয় ছিনিয়ে আনলেন? লাভের খাতায় কি যোগ হল?

এম এ মুহিতঃ আমি বাবা মায়ের একান্তবাধ্যগত সন্তান নই। বুঝতাম উনারা কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু উনাদেরও তো দায়িত্ব আমার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেওয়া। বাবার ইচ্ছা মার ইচ্ছা আপনি ডাক্তার হবেন। আপনার ইচ্ছা কি? নিজেকে জিজ্ঞেস করেছেন? বাবা মা কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছেন? সবার ভেতরে একটা স্বভাবজাত প্রতিভা থাকে সেটাকে যদি উৎসাহ দেওয়া যায়, সে সফল হবে। কাজ কে উপভোগ করবে। আমি ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাসায় ঈদ করিনি। কোনো না কোনো পাহাড়ে কাটতো ঈদ।

পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। ভাইবোনের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। সব ঠিক রেখে আমি যাই করি না কেন সমস্যা কি? আমি তো তাদের সম্মানহানী হবে এমন কিছু করিনি। আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আছে। তবে যখন বিজয় পেলাম তখন উনারা বুঝতে লাগলেন। আর সবসময় নিজেকে নিজে সাপোর্ট দিয়েছি।

গত বছর আমার মাকে হারিয়েছি। আর বলে রাখি ছোট কালে দুরন্তপনা জন্য বাবার হাতে প্রচুর মার খেয়েছি। মা সবসময় বাঁচাতেন বাবার হাত থেকে।

আর লাভের কথা বলতে গেলে সবাই আমাকে চিনছেন। এটা কম কি? অনেক জায়গায় সম্মান পাই। সম্মান থেকে বড় জিনিস তো আর কিছুই হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনা দিয়েছেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী দিয়েছেন। এগুলো তো টাকায় পাওয়া যেত না। দেশের বড় বড় ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্টজন, সুশীল সমাজের মানুষজনের কাছ থেকে যে ভালোবাসা আর স্নেহ পাই এটাই তো বড়। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কেউ আমাকে আলাদা ভাবে চিনছে এটা কি কম?

হ্যালোঃ সাফল্যের সংজ্ঞা কি আপনার কাছে?

এম এ মুহিতঃ সফলতার পিছে না ছুটে যোগ্য হতে হবে। যোগ্য হলে একদিন সফলতা ধরা দেবেই।

হ্যালোঃ সফল হতে আমাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি হতে পারে ?

এম এ মুহিতঃ নিজ সত্তাকে আবিষ্কার করেন। কে কি বলল কান দেবেন না। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমার দ্বারা সম্ভব। আমি শুধু লেগেছিলাম বাকিটা হয়ে গেছে। তাই আপনাকে শুধু স্বপ্নের পেছনে লেগে থাকতে হবে। তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তি আপনাকে আটকাতে পারবে না।

আমরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি খাওয়া আর অর্থ উপার্জনের জন্য? নিশ্চয় না। আমরা খাই এবং অর্থ উপার্জন করি বেচেঁ থাকার জন্য। অনেক কিছুই করার আছে আমাদের।

সুখ তো নিজের শখ পূরণের মধ্যেই। মনের বিরুদ্ধেই যদি চলতে হয় তাহলে বেঁচে কি লাভ? মনের পক্ষে চলবেন কবে? মৃত্যুর পর?

হ্যালোঃ ধন্যবাদ। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।

এম এ মুহিতঃ শুভ কামনা আপনার জন্য।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com