'মাদ্রাসার স্যারে বেত দিয়া মারত'

উত্তর আর দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাতায়াতের মাধ্যম তিন কিংবা চার চাকার টেম্পো। আর বেশিরভাগ টেম্পোতে সহযোগী হিসেবে কাজ করে শিশুরা।

এমনই এক শিশুর সঙ্গে একদিন বিকেলে দেখা হল।

একগাদা মানুষের ভিড় ঠেলে চকবাজার থেকে আগ্রাবাদ যেতে এক টেম্পোতে উঠে পড়ি। ভেতরে আসন ফাঁকা না থাকায় পাদানিতে দাঁড়াতেই একজনের পায়ে পা লাগে। 

শহুরে অভ্যস্ততায় ‘স্যরি’ বলতে গিয়ে খেয়াল করি যার উপর পা পড়েছে সে টেম্পোর হেল্পার।

পাদানিতে ঝুলতে ঝুলতেই কথা হয় ওর সঙ্গে। ওর নাম জুয়েল।

হ্যালোঃ বাসা কোথায়?

জুয়েলঃ ডিসি রোড।

হ্যালোঃ শুনতে না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করি, ডিসি হিলে থাকো তুমি?

জুয়েলঃ ডিসি রোড। ডিসি হিল না আবার!

হ্যালোঃ আচ্ছা। কখন থেকে এই কাজ শুরু কর?

জুয়েলঃ সকাল থেকে।

হ্যালোঃ বাড়িতে কে কে আছেন?

জুয়েলঃ সবাই।

হ্যালোঃ যা পাও তা দিয়ে চলে?

জুয়েলঃ ভালোই চলে। আব্বাও তো কাজ করে।

হ্যালোঃ উনি কী করেন?

জুয়েলঃ মুরগির দোকান করে।

পথে এক জায়গায় টেম্পো থামলে লোক নামে। ভেতরে ফাঁকা হওয়ায় ভাবলাম ভেতরে গিয়ে বসি। পর মুহূর্তেই চিন্তাটাকে বাতিল করে দিয়ে ঝুলে থাকাকেই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করলাম।

টেম্পো চলতে শুরু করলে আবার আমাদের কথা শুরু হলো।

হ্যালোঃ পড়ালেখা কর না?

জুয়েলঃ না ভাই। ছেড়ে দিসি।

হ্যালোঃ ছাড়লা কেন?

জুয়েলঃ যে মাইর মারে...!

হ্যালোঃ মারে?

জুয়েলঃ হ ভাই। যে মাদ্রাসায় পড়তাম, ওইটার স্যারে বেত দিয়া জোরে জোরে মারত। 

পরে গিয়া স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে থ্রি পর্যন্ত পড়ি। ওইখানেও মারত। তয় মাদ্রাসায় বেশি মারত।  

ওর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল মারের ভয়ে কেউ আবার পড়া ছাড়ে নাকি?

জুয়েল স্কুলে পড়লে হয়তো অনেক ভালো কিছু করতে পারতো। কিন্তু এখন টেম্পোর পেছনে হ্যান্ডেল ধরে "আগ্রাবাদ, আগ্রাবাদ" করে চেঁচানো ওর নিয়তি হয়ে গেছে। আরেকটু বড় হলে হয়তো তার পদোন্নতি হবে বাস অথবা টেম্পোর চালক হিসেবে।

মারের ভয়ে জুয়েলের লেখাপড়া গেল ঘুঁচে। এর দায় কে নেবে?

এখন আঙ্গুল তুলব কার দিকে? প্রশাসন? আইনের অব্যবস্থাপনা না সেই শিক্ষকদের দিকে? 

২০১০ সালের ৯ অগাস্ট দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে এক পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সৈয়দ আতাউর রহমান স্বাক্ষরিত এ পরিপত্রে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়াকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে, ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য এক পরিপত্র জারি করে। এ ব্যাপারে হাইকোর্টেরও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ রয়েছে।

পরিপত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি দেওয়া বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

যারা শারীরিক শাস্তি দেবেন তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৮৬০, ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এবং ক্ষেত্রমতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ গ্রহণেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

একটু উন্নত স্কুলগুলোতে কোনো শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে পড়ে থাকা শিশুরা যারা স্কুলে নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের খবর কে নেয়?

স্কুলে, পরিবারে যেখানেই হোক না কেন শিশু নির্যাতন কাম্য নয়। শিশু বেড়ে উঠবে আদরে, স্নেহে আর ভালবাসায়। শিশু বেড়ে উঠার জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি একান্ত জরুরি। ভুলে যাবেন না শিশুরাই সম্পদ, ভবিষ্যৎ।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com