তারপরও প্রতিদিনের যানজট আর ব্যস্ত শহর দেখতে দেখতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই ভাবতাম শুধু কি ঢাকা আর এখানের শিশুদের নিয়েই লেখালেখি করব? যদি তাই হয় তবে ঢাকার বাইরের শিশুদের সাথে মিশব কীভাবে?
এসব ভাবতে ভাবতেই সুযোগ পেলাম বাইরে যাওয়ার। কিছুদিনের মধ্যেই ইউনিসেফের 'শিশু যোগাযোগ বাংলাদেশ' এর নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে চট্রগ্রামে গেলাম।
সারাদিন মাউথ স্টিক নিয়ে নিউজ প্রেজেন্টারের কাজ করলাম। সেখানকার বেশ কিছু শিশুর সাথে কথা বললাম। তাদের সাক্ষাতকার নিলাম।
একদিন দুপুরের খাবার শেষে হোটেল থেকে নিচে নেমে সবাই গল্প করছিল। আমিও গল্প করছিলাম। তবে আমার বন্ধুদের সাথে না।
আমি গল্প করছিলাম চট্রগ্রামের দুজন শিশুর সাথে। তাদের সাথে গল্প করে জানতে পারলাম ওদের একজনের নাম মুনিয়া আক্তার আর আরেক জনের নাম লিটন।
দুজনের দারুণ বন্ধুত্ব। সারাদিন নাকি তারা একসাথেই ঘুরে বেড়ায়। কখনও লাটিম খেলে, ঘুড়ি উড়ায়। আবার কখনও ইটের ছোট টুকরা নিয়ে খেলা করে। তারা নাকি প্রায়ই মারামারি করে। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব অভিমান ভুলে আবার একসাথে হয়ে যায়।
কথায় কথায় জানলাম, মুনিয়ার মা নেই, এক বছর আগে মারা গেছে। সে তার বাবা আর দুই বড় ভাইয়ের সাথে থাকে। বড় ভাই দোকানে কাজ করে আর ছোট ভাইটি ওর মতো খেলাধুলা করে।
রিক্সা চালক বাবা নাকি তাকে একটা নতুন জামা কিনে দিয়েছে। সেটা নিয়ে তার আনন্দের শেষ নেই। ও আমার কাছে জামাটার বর্ণনা দিতে শুরু করলো। জামাটি নাকি সবুজ রঙের। তাতে দুটো লাল রঙের বোতাম আছে। পেছনে দুটো বেল্টও আছে।
আমিও বেশ মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম ওর সুখের কথা। আর ভাবছিলাম আট বছর আগে আমার যেমন নতুন কিছু নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ ছিল না তেমনি এখন মুনিয়ারও সেই একই অবস্থা। মনে হচ্ছিল আমি যেন আবার আট নয় বছর বয়সে চলে গেছি।
আর লিটন তার বাবা মার সাথে মুনিয়াদের পাশেই থাকে। তারা দুজনে একই বস্তিতে থাকে। তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে।
বাবার কথা বলাতেই সে বলে উঠে "আমার বাবা বিল্ডিং বানায়।” তার আরও দুইটা বোন ও একটা ছোট ভাই আছে।
সে সারাদিন মুনিয়ার সাথে খেলে। সকালে তারা মুড়ি খেয়েছে। তারপর থেকে দুপুর পর্যন্ত না খাওয়া। তবুও ওদের মনে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। কারণ না খেয়ে থাকাতো আর নতুন কিছু না। বরং প্রতিদিনের রুটিন। এতেই ওরা সুখি।
ওরা খুব সহজ সরল। মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে। ওদের সাথে আমার খুব অল্প সময় কথা হয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমি ওদের অনেক আপন।
হাসতে হাসতে আবার ওরা চলে গেল। ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমার ভাগ্য ভালো যে আমি সাংবাদিক হতে পেরেছিলাম। নয়ত এই সুখগুলো কখন দেখাই হতো না। লিটন আর মুনিয়া হয়তো আমার খুব দূরের মানুষ হতো। আর না হলে হয়ত বাকিদের মতই আমিও ওদের এড়িয়ে চলতাম।