আম্মু প্রায়ই বলেন, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, ভালো করে কথা বলতেও পারতাম না সেই সময় থেকেই নাকি বই কিংবা পত্রিকা হাতের কাছে পেলে চেয়ে থাকতাম বড়দের মতো!
আর স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর যখন বানান করে পড়তে শিখলাম তখন থেকে বাসায় রাখা যে কোনো বই পেলে সবার আগে আমি পড়ে ফেলতাম।
আরেকটু বড় হতেই শুরু হলো পত্রিকা পড়া। আব্বু নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। পত্রিকা পড়া এমন নেশার মতো হয়ে গেল যে একদিন না পড়লে আমার কেমন খারাপ লাগত।
পত্রিকার সবগুলো লেখা আমি পড়তাম। তবে ছড়া আর গল্প পড়তে ভালো লাগত বেশি। লেখাগুলো পড়তাম আর মনে মনে ভাবতাম যদি আমার লেখাও পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো!
তখন থেকেই টুকটাক লেখা শুরু। ভয়ে কাউকে কিছু দেখাতাম না, যদি কেউ বলে এসব কিচ্ছু হয়নি
কী লিখতাম তা হয়ত নিজেও বুঝতাম না। তবে এখন মনে হচ্ছে সেগুলো ছিল এক রকম গল্প।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথমবারের মতো আমাদের স্কুল থেকে ম্যাগাজিন বের হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। সবাই যার যার মতো করে লেখা দেয়। আমিও একটি লেখা দিয়েছিলাম।
এই প্রথম কোথাও লেখা প্রকাশের জন্য দেওয়া। বেশ আশা নিয়ে ছিলাম।
মনের ভেতর অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করতে লাগল। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ম্যাগাজিন বের হবে আর আমার লেখাটা দেখতে পাব। লেখা জমা দেওয়ার কথাটা একমাত্র আম্মুকেই বলেছি। কারণ আম্মু ছাড়া আর কেউই জানে না যে আমি লেখালেখি করি। আম্মু আমাকে সবসময় উৎসাহ দিতেন।
এর কিছুদিন পর হঠাৎ করেই ঘোষণা হলো এবার আর ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবে না, তবে দেয়ালিকা হবে। আর দেয়ালিকা কবে হবে তা কেউ বলল না। আমি খুব কষ্ট পেলাম।
আম্মু আমাকে শান্তনা দিয়ে বললেন, 'লেখা প্রকাশিত হয়নি তো কি হয়েছে? আরো বেশি করে লিখতে থাক, একদিন না একদিন নিশ্চয়ই প্রকাশ পাবে।’
আম্মু প্রায়ই আমার লেখাগুলো পড়তেন, প্রশংসা করতেন। লেখা কী রকম হয়েছে তাও বলতেন। আমার বেশ ভালো লাগত। এক কথায় আম্মুর উৎসাহে আমার লেখালেখি চলতে থাকে।
হঠাৎ একদিন আম্মু বললেন, আমার লেখাগুলো উনি স্থানীয় একটি পত্রিকায় দিতে চান। শুনে তো আমি খুব খুশি।
এরপর একদিন স্কুল বন্ধের দিন দেখে আম্মু আমাকে নিয়ে গেলেন ওই পত্রিকার অফিসে।
সম্পাদকের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। উনি বললেন, ‘ছাপানোর বিষয়ে ভেবে দেখবেন।’ তারপর লেখাগুলো উনি রেখে দিলে আমরা চলে এলাম।
সেদিন থেকে শুরু হলো আবার এক অপেক্ষা। হকার কাকার সাইকেলের বেল শুনলেই ছুটে যেতাম বাইরে। তবে এবার আমাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। সে সপ্তাহেই পত্রিকাটির শিশুদের পাতা ‘শিশু মেলা’য় আমার লেখা ছাপা হয়।
পত্রিকার পাতায় নিজের লেখা দেখে এত আনন্দ লেগেছিল, বলে বোঝানো যাবে না।
তাড়াতাড়ি পত্রিকাটা আম্মুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আম্মু আজ আমার লেখা ছাপা হয়েছে।’
আম্মু তখন মুচকি হেসে বললেন, ‘এই তো আমার লেখক আব্বুটার লেখা প্রকাশ পেতে শুরু করল। আর কেউ থামাতে পারবে না।’