প্রাথমিক পর্যন্ত তেমন না বুঝলেও মাধ্যমিকের ক্লাস করতে গিয়ে বুঝলাম পড়ালেখাটা ভালো করে না করলে হবে না। তাই পড়ছিলাম বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে। ফলাফলও পাচ্ছিলাম হাতেনাতে। একশ ৭০ জনের মধ্যে সব সময় ২০ জনের মধ্যে থাকতাম।
বিপত্তিটা বাধে জেএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময়। কেন্দ্র ছিল নিজেদের স্কুল। তাই তেমন ভয় ছিল না। পড়েও ছিলাম অনেক।
প্রথম দিন ছিল বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা। খুব ভালো দিলাম। দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার দিন দেখলাম আমার কক্ষের ছেলেরা নোট বই বের করে নকল করছে। স্যাররা দেখেও কিছু করছেন না। কারণ কেন্দ্র, স্যার সব আমাদের। সেদিন থেকে কি যে হলো- বাড়ি গিয়ে ভাবলাম কেউ তো পড়ছে না। একা কেন পড়ব। পরীক্ষা দিলাম বন্ধুদের মতো নকল করে। আজ ভাবতেই খুব লজ্জা করে ভালো রেজাল্ট ছিল, সব পড়া ছিল তবুও নকল করেছি।
লিখিত পরীক্ষা নিজেরা নানা ভাবে টুকে দিলেও নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নগুলোর উত্তর স্যাররাই করে দিতেন রোজ। ভাবলেই এখন ভয় হয় কতটা ধ্বংস হয়েছি আমি, আমরা। যদিও আমাদের কেন্দ্র পরিচালনার ভার অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকের হাতে ছিল।
তখন থেকেই আমরা সবাই পড়ালেখা রেখে নকলনির্ভর হয়ে পড়ি। জেএসসি পরীক্ষায় আমাদের ফলাফল হয় খুব ভালো।
নবম শ্রেণিতে ভর্তির পরপরই জানতে পারি আমাদের এসএসসির কেন্দ্রও হবে এই স্কুলেই। নবম শ্রেণির সারা বছর কেউ কোনো পড়ালেখা করেনি। বছর শেষে জানা গেল কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হবে। আমরা আবার পড়া শুরু করলাম। ভালোই পড়ছিলাম। অনেক পড়া। কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
দশম শ্রেণির ক্লাস শুরু পর পরই জানা গেল আমাদের কেন্দ্র আগের জায়গাতেই থাকবে। এটা শুনে যথারীতি আমরা বই শিকেয় তুললাম।
আমরা নকল করব জেনেই স্যাররা ঠিক করলেন টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নয়, যারা ভালো করবে শুধু তাদেরকেই পরীক্ষায় বসানো হবে। তাই হলো কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। আমরা যারা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেলাম তারাও যে খুব একটা ভালো করলাম টেস্টে তাও না।
পরীক্ষা চলে এল। আমরা জেএসসির পুনরাবৃত্তি করলাম। স্যাররা আবার আমাদের নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নের সমাধান করে দিলেন।
বিপত্তি বাধল পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষার দিন। আমাদের তত্ত্বীয় লেখা শেষ হওয়ার পর নৈর্ব্যত্তিক খাতা দেওয়া হলো। স্যাররা অনেকের খাতা জমা নিয়ে নিজেরাই বৃত্ত পূরণ করতে শুরু করলেন। আমারটা আমিই করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম স্যাররা খাতা ফেলে ছোটাছুটি করছেন।
থানা শিক্ষা অফিসার এসেছিলেন সেদিন। আমাদের ক্লাসের তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কার করা হয় কেন্দ্র সচিবকেও। পর পর তিন দিন তিনি আসেন পরিদর্শনে। সারা বছর পড়ালেখা না করায় আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়। কিছুই প্রায় পারছিলাম না। কোনো রকম পাশ করতে পারলে বাঁচি- এই চিন্তা করছিলাম তখন।
আমাদের ফল বিপর্যয় হয়। সেদিনই বুঝেছিলাম নকল নির্ভর পড়ালেখা কখনও সুফল বয়ে আনে না। অনেক দিন মনের ভেতর চেপে রেখেছিলাম এই দুঃসহ যন্ত্রণা। আজ হ্যালোতে লিখে বেশ ভালো হালকা লাগছে।