স্মৃতিরা কাঁদায়

জীবনের অনেক কিছু স্মৃতির এলবামে জমা হয়ে আছে। সাদা পাতায় ঝাপসা হরফে লেখা হয়ে আছে ব্যথা আর পুলকের অজস্র কথা। সেই স্মৃতির মিছিলে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাই নিজেরই অজান্তে। খুঁজে বেড়াই পুরান দিনের কথা। বেদনার কথা। আনন্দের কথা। 
স্মৃতিরা কাঁদায়

বরফের মতো জমাট বেঁধে আছে আমার সমস্ত অতীত। জীবনের কিছু মুহূর্ত স্থির হয়ে আছে সিনেমার স্থির দৃশ্যের মতো। নড়ে না। জোনাকির মতো জ্বল জ্বল করে ওঠে। কাঁদায়। এমনি কিছু স্মৃতির জন্য প্রতিনিয়ত কাঁদি আমি। জামার কোণ দিয়ে অশ্রু মুছে ফেলি।

২০১৩ সাল। মাধ্যমিকে পড়ি তখন। চাঞ্চল্য তখনও আমাকে ঘিরে রেখেছে মা যেমন সন্তাকে আগলে রাখে।    

সেদিন বৃহস্পতিবার। দুপুরে ক্লাস শেষ। বাড়ি চলে এলাম। বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরে ভাইয়া নেই। কোথায় জানি গেছে। মা নামাজের বিছানায় বসা। কাল শুক্রবার। ছুটির দিন। একটা মাত্র দিন। অথচ এই একদিনের জন্যই অনেক জল্পনা কল্পনা চলছে মাথায়।

এই করব, সেই করব। ঘুরতে বেরোব। দুষ্টুমি করব। বন্ধুদের সঙ্গে খেলব। কিন্তু একদিনে সব কাজ শেষ হয় না। চোখের পলকে চলে যায় দিনটা। দুপুরের খাবার খেয়ে মাকে বললাম, ছোট ফুপুর বাড়ি যাব। ছুটির দিন তাই মা আর আপত্তি করেন না। শর্ত, পরের দিন বাড়ি ফিরতে হবে।

ফুপুর বাড়ি যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। ফুপু আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোরে অনেক দিন ধরে দেখি না রে। তিন-চার দিন থাকবি তো?

মুচকি হেসে আমি বললাম, নাহ্। মা একদিনের ছুটি মঞ্জুর করেছেন। তবে দুই দিন থাকব।

আষাঢ়ের ভোর। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ফুপাতো ভাইবোনদের সাথে তাই খেলছি ঘরেই। হঠাত ফুফু এসে ঢুকলেন। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। আমার কাছে এসে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠেন, ‘তোর নানা মারা গেছে রে!’ আমি থমকে যাই। হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে আমার। চোখ ঝাপসা হয়ে যায় মুহূর্তের ভেতর। বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।

কথা গলায় এসে থেমে যায়। মুখ শুকিয়ে গেছে দেয়ালের মতো। শব্দ না করে এক ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে দুই ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে আমার মুখের ভেতরে চলে যায়। নোনতা পানি। শরীরের ঘামের মতো লবণাক্ত।

নানার কুঁচকে যাওয়া মুখের ছবি ভেসে ওঠে মনে। তখনও আমি কাঁদতে খুব লজ্জা পেতাম। আড়ালে গিয়ে নিঃশব্দে কাঁদি অনেক্ষণ। পাঞ্জাবির হাতা ভিজে যায় চোখের জলে। শব্দ করে কাঁদা আমার অভ্যেস নেই।

জন্মের আগেই হারিয়েছি আমার নানিকে। নানা বাড়ির তেমন একটা আদর আমরা ভাই-বোন কেউই পাইনি। পাঠ্য বইয়ে যখন পল্লী কবির ‘মামার বাড়ি’ কবিতা পড়ি, তখন আমার ভেতর হু হু করে ওঠে। একটা অদৃশ্য বেদনা বোধ করি। সে সব বেদনার রঙ দেখতে পাই না, অনুভব করি। ছুঁতে পারি না, আঁচ করতে পারি। কেবল চেয়ে থাকি কল্পনার রহস্যমাখা পথে। যে পথে আমার প্রিয় নানি আর আজ আমার নানা চলে গেলেন।

না চেনা সেই শহরে ভালো থাকুন নানাজান, সুখে থাকুন নানিজান। আপনারা দুজনই আমার ভেতরে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com