গেরুয়া বসনে বিজ্ঞান স্যার

আমাদের বাড়ি মফস্বলে হওয়ায় শহর থেকে শিক্ষক এনে বিভিন্ন বিষয় পড়তে হয়েছে। তেমনি জীববিজ্ঞানও পড়তে হয়েছে শহরের একজন শিক্ষকের কাছে।

প্রথম যেদিন জীববিজ্ঞান স্যার এলেন, সেদিনটার কথা আজও মনে আছে। তার পরনে গেরুয়া বসন, মাথায় টিকি, সাধু সাধু চেহারা দেখে  খুব হাসি পেল আমাদের। ভাবলাম তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষক তাও আবার জীববিজ্ঞানের! সবাই মুখ টিপে টিপে হাসছিলাম। 

কিন্তু তার পড়ানোর কৌশল দেখে বেশ ভাল লেগে যায়। বুঝতে সময় লাগল না, তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। উনার নাম কানাই লাল বিশ্বাস।

পরিচয় পর্বে জানলাম তার বাবা একজন কৃষক ছিলেন। পরিবারের কেউ কখনও পড়ালেখার কথা ভাবতেও পারেননি। তিনি নিজের আগ্রহে লেখাপড়া করেছেন। বাধা ডিঙিয়ে ভর্তি হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম পি এল ও পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক উনি।

সব মিলিয়ে আমরা বছর খানেক তার সান্নিধ্য পেয়েছি। এক বছরেই তিনি আমাদের জীবনের বাস্তবতাটাকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতেন। ছিল বন্ধুসুলভ স্বভাব। তাকে আমরা শিক্ষক না ভেবে কখন যে বন্ধু ভাবতে শুরু করেছিলাম বুঝতে পারিনি।

ব্যাচের সব থেকে খারাপ ছাত্র ছিলাম আমি। এমন কোনো দিন নেই তার কাছ বকাঝকা শুনিনি। বকা খেয়ে মাঝে মাঝেই খুব রাগ হতো আমার। তখন পড়া পারলেও ইচ্ছে করেই ভুল বলতাম।   

একদিনের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। পড়া না পারায় তিনি আমাকে বললেন, "পড়াশোনা তো করো না । ভবিষ্যতে কী করবে?"

আমি বললাম, "ভবিষ্যৎ  মরীচিকা, আসবে না কখনও। যদি আসে তাহলে তখন ভেবে নেব।"

স্যার সেদিন সবার উদ্দেশ্যে বললেন, "অভিজিৎ মোক্ষলাভ করেছে।"

সবাই খুব হেসেছিল। তখন বুঝিনি  কিন্তু এখন এই কথাটা আমাকে পীড়া দেয়। কারণ স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আর কখনও ফিরবেন না শুনেছি।

দেশের এই অবস্থায় তিনি খুব ঝুঁকিতে আছেন বলে পরিবারসহ দেশ ছাড়ছেন, এই কথাটা যেদিন শুনেছি কষ্টে দুমড়ে গিয়েছিল বুকের ভেতর।   

বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়। বরাবরের মতো ঘুমের কারণে পৌঁছতে আধঘণ্টা দেরি হয় আমার। গিয়ে দেখি সবাই পৌঁছে গেছে। অনেকে চলেও যাচ্ছে দেখা করে।

সবাইকে বিদায় দেওয়ার পর স্যার আমাকে আলাদা করে ডেকে নেন। আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। তিনি অনেক উপদেশ দিলেন।

বললেন, “এতদিন ধরে যে বকেছি সেটা ভুলে যেও না। ভেতরের আগুনকে নিভে যেতে দিও না। এই আগুন জ্বালিয়ে রাখতে পারলে তোমার জীবনে অনেক কিছু হবে।"

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনছিলাম। হঠাৎ মনে হল স্যারের কণ্ঠটা বেশ ধরা ধরা লাগছে। তাকিয়ে দেখি তার চোখে জল।

তিনি খুব তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিলেন। চোখের জল লুকাতেই হয়তো চলে গেলেন। পা ছুঁয়ে প্রণামটুকুও করতে পারিনি।

স্যারের চোখে জল দেখে আমার খুব কষ্ট হল। দেশ ছাড়তে স্যারের কতটা কষ্ট কে জানে? যে দেশের আলো বাতাসে বড় হলেন সে দেশ ছাড়তে কষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com