আমার মেঘবালিকা ও শিক্ষাসপ্তাহ (শেষ পর্ব)

যাইহোক প্রতিযোগিতা শুরু হল। কেউ 'স্বাধীনতা', কেউ 'মাগো ওরা বলে' আবার অনেকেই বিদ্রোহ আর সংগ্রামের কবিতা আবৃত্তি করল। তাদের উচ্চারণে বিশাল বিশাল ভুল। একটু কষ্ট পেলাম। কবিতা তো যা তা বিষয় নয়। তাদের এটা কে বোঝাবে?

কাউকে কাউকে বলতে শুনলাম যুদ্ধের কবিতা, শৌর্যের কবিতা বললে বেশি নম্বর পাওয়া যায়। উফ! ওরা কবিতা পড়ছে নম্বরের জন্য। কী দুঃসহ!

সবার শেষে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম। গিয়ে খুলে দিলাম মেঘবালিকার জন্য লেখা রূপকথার ঝাঁপি। আমি প্রথম হলাম আবৃত্তিতে। দশ জনের বজ্রকণ্ঠের কাছে মেঘবালিকার অযথা কথা বার্তা টিকে গেছে শুনে অবাকই হয়েছিলাম।

এর কদিন পর সকাল সকাল হিমু সাজে, রাঙাদির হাত ধরে পৌঁছলাম ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। স্কুলে ঢুকেই হল রুমে চলে গেলাম।দেখলাম রুমের এক পাশে জটলা খানিকটা। সেখান থেকে কোথায় কোন প্রতিযোগিতা হবে তা ঘোষণা করা হচ্ছে। ঘোষণা শুনে গিয়ে বসলাম এক তলার ১৬নং রুমে। দরজায় দাঁড়িয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিচারকের আসনে যাকে দেখলাম তিনি আমার পূর্বপরিচিতা। তার সঙ্গে আমার এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দেখা হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। সে গল্প আরেক দিন শোনাব।

খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই ম্যাডামের একটি আবৃত্তি স্কুল আছে। তিনি সেখানে বিতর্ক, বক্তৃতাসহ আরো কিসের কিসের যেন ক্লাস করান। সেখানে শহরের সুশীল বালকেরা ভর্তি হয়। ভর্তি ফরমের দাম শুনে চোখ কপালে উঠল। একটা আত্মশুদ্ধির চর্চাকে, মনন বিকাশের চর্চাকে এরা এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে সেটা ভাবলে কষ্ট হয় খুব। তবু মেনে নিতেই হবে।

প্রতিযোগিতা শুরু হল। কিন্তু মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত নীতিমালা মানতে নারাজ তিনি। নীতিমালায় লেখা ছিল কেউ চাইলে নিজেদের রচিত বা নিজেদের নির্বাচিত কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে। নিজেদের রচিত কবিতা আবৃত্তির অনুমতি মিললেও নিজের নির্বাচিত কবিতা আবৃত্তি করতে দিলেন না তিনি।

তিনি তার ইচ্ছে মতো একটা কবিতা দিলেন। তা দেখে তার আবৃত্তি স্কুলের শিক্ষার্থী লাবীব মাহাদি বেশ খুশি হল বলে মনে হল। কারণ ম্যাডাম যে কবিতা নির্বাচন করলেন সেটা ওর 'কমন' পড়েছে।

আমার মেঘবালিকার কি হবে ভেবে ভেবে ঠিক করলাম একটা স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করব। কিন্তু আমার হাতে তখন কোনো কবিতা নেই। মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম।  তখনই বসে লিখে ফেললাম বর্ণবাদ বিরোধী একটি কবিতা। আমাদের দেশের যে নারীরা শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য যোগ্যতা থাকার পরও নানা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন তাদের জন্য লিখে ফেললাম কবিতাটি। সব নারীকে মা সম্বোধন করে লিখলাম আমার কবিতা। দুটো কপি করলাম। এক কপি বিচারকের হাতে দিলাম। তিনি কবিতাটা আলগোছে রেখে দিলেন। আমার ভাগ্যে সেদিন কি ঘটেছিল তা কি বলে দিতে হবে?

যাইহোক আমার পেছনে তিয়ানা নামের একজন বসেছিল। নবম শ্রেণিতেই পড়ে। জামালপুর বাড়ি। খুব সুন্দর আবৃত্তি করে। একবার শুনলে মনে হয় যেন বারবার শুনি! সেই তিয়ানা আমার কবিতাটা পড়তে চাইল। দিলাম। ও পড়ল। তার ভাবান্তর হল কিছুটা। তারপর ফিরিয়ে দিল। কিছু বললাম না।

সবার আবৃত্তি শেষ হলো। লাবীব মাহাদির প্রথম হওয়ার কথা ছিল, সে প্রথমই হলো।

চলে আসছিলাম আমি। তিয়ানা ডাকল। বলল, তোমার কবিতাটা আমায় দেবে? তখন মনে হলো, জীবনে সব পেয়ে গেছি। একজন আমার কাছে আমার কবিতাটা চাইছে, আমি কি না দিয়ে পারি? একদম সম্প্রদান করে দিলাম কবিতাটা। শিক্ষাসপ্তাহে নানা কুশিক্ষা পাওয়ার পর এই ত্যাগই আমার জীবনের সববচেয়ে বড় পাওয়া।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.

সর্বাধিক পঠিত

No stories found.
bdnews24
bangla.bdnews24.com